- অর্থনীতি
- রিং শাইন শেয়ার নিয়ে ব্যাপক জালিয়াতি
রিং শাইন শেয়ার নিয়ে ব্যাপক জালিয়াতি

আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগের বছর ঢাকা ইপিজেডের কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইলের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৯ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সবাই ব্যাপক শেয়ার জালিয়াতি করেন বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি করতে যে প্রসপেক্টাস প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে এ কোম্পানির ৯ উদ্যোক্তা-পরিচালক নিজেদের সিংঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান এবং ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। তালিকাভুক্তির বছরই এদের অধিকাংশই দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপর কোম্পানিটির উৎপাদন দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে নতুন নেতৃত্ব আসার পর তারা রুগ্ন ও বন্ধ কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেয়।
এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত জানুয়ারিতে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মেজবাহ উদ্দিনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা জানতে বিশেষ অডিট ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালন করে। ওই তদন্তেই রিং শাইনের শেয়ার জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে।
জানা গেছে, শেয়ার বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা না দিয়েই ১৬১ কোটি টাকার মূল্যের ১৬ কোটি ১০ লাখ শেয়ার নিজেদের নামে নিয়েছিলেন তারা।
আইপিওতে আসার দুই বছর আগে ২০১৭ সালে ৯ বিদেশি উদ্যোক্তার নামে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের মাত্র ৩১ লাখ শেয়ার ছিল। যার প্রকৃত মূল্য ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা।
আইপিওতে আসার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালেই এই ৯ পরিচালক আরও ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ২২০টি শেয়ার নতুন করে নগদ টাকায় নিয়েছেন বলে আইপিও প্রসপেক্টাসে তথ্য দেন।
কিন্তু কমিশনের তদন্তে দেখা গেছে, তারা প্রকৃতপক্ষে এ শেয়ার কিনতে কোনো টাকাই কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা দেননি। এমনকি তালিকাভুক্তির পর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার তিন বছরের লকইন (শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা) থাকায় নির্বিঘ্নে কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিতে নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠান ইউনির্ভাসাল নিটিং এবং লার্ক টেক্সটাইলের নামেও ২৪ কোটি টাকায় শেয়ার নেন। এক্ষেত্রেও কোনো টাকা পরিশোধ হয়নি। শুধু উদ্যোক্তা ও পরিচালক এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠানই নয়, এর বাইরে অন্তত ৩৩ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও টাকা ছাড়া প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার নিয়েছেন।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জানিয়েছে, বিনা টাকায় যারা জালিয়াতি করে শেয়ার নিয়েছেন, তাদের সব শেয়ারই বাতিল করা হবে। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, শেয়ার বাতিল হলে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমবে। একই সঙ্গে এই শেয়ারের বিপরীতে পাওয়া মূলধন হালাল করতে ভুয়া সম্পদ মূল্য দেখানো হয়েছে। শেয়ার বাতিল হলে ওই সম্পদের হিসাবও বাতিল হবে। তাতে কোম্পানির সম্পদ মূল্যও (এনএভি) কমে যাবে।
আইপিওতে আসার আগের বছরে ৭৩ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ১১৪ কোটি টাকার প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি দেখিয়েছে কোম্পানিটি।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিএসইসি জানিয়েছে, আইপিওতে আসার আগের বছর কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ২৮৫ কোটি ০৫ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। এর মধ্যে সকল উদ্যোক্তা এবং ৩৩ বাংলাদেশি টাকা ছাড়াই জালিয়াতি করে শেয়ার নিয়েছেন। তবে তার মোট পরিমাণ কত, তা জানায়নি সংস্থাটি।
বিএসইসি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানায়, ২০১৮ সালে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি দেখিয়ে ২৭৫ কোটি ০৫ লাখ টাকার মূলধন বাড়ায়। এক্ষেত্রে ১১ উদ্যোক্তা-পরিচালক (প্রকৃতপক্ষে ৯ উদ্যোক্তা এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠান) এবং ৭৩ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি দেখানো হয়।
কিন্তু ১১ উদ্যোক্তা এবং ৩৩ বাংলাদেশি শেয়ারহোল্ডার এই শেয়ার নিতে নগদ মূল্য পরিশোধ করেছেন বলে আইপিও প্রসপেক্টাসে তথ্য দিয়েছেন। আসলে তারা কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি।
শেয়ার জালিয়াতির এ তথ্য গত ২০ মে প্রথম প্রকাশ করেছিল বিএসইসি। ওইদিনও সংস্থাটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, কমিশন সভায় আইপিও পূর্ব শেয়ারের মধ্যে টাকা ছাড়াই যতগুলো শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল, তার সবটাই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইপিওতে আসার আগের বছরে ৭৩ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ১১৪ কোটি টাকার প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি দেখানো হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, এর মধ্যে ৩৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই জালিয়াতি করে শেয়ার নিয়েছেন।
আইপিওর আগে রিং শাইন টেক্সটাইলের পরিশোধিত মূলধন ছিল ২৮৫ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালক এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠানের অংশ ছিল ১৭১ কোটি টাকা।
আইপিও প্রক্রিয়ায় ১৫০ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করে তালিকাভুক্ত হলে এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩৫ কোটি টাকা। তালিকাভুক্তির পর ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিলে তা বেড়ে ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
রিং শাইনের আইপিও প্রসপেক্টাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির চেয়ারম্যান সুং জে মিন, এমডি সুং ওয়ে মিনসহ ৯ উদ্যোক্তার শেয়ারমূল্য ছিল অভিহিতমূল্যে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। আইপিওতে আসার আগের বছর যা বেড়ে ১৩৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা ছাড়ায়। অর্থাৎ ১৩৪ কোটি টাকার শেয়ারই জালিয়াতি করে নিয়েছেন।
বিএসইসি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ জালিয়াতির কারণে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটির প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন হয়নি। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। শেয়ার জালিয়াতির এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও শেয়ারবাজার আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কমিশন সূত্র জানায়, আইপিও প্রসপেক্টাসে দেওয়া নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান মাফেল হক অ্যান্ড কোং এর দায় খতিয়ে দেখা হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ইস্যু ম্যানেজার ও অডিটর প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা দরকার ছিল। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। করলে এ জালিয়াতি হতে পারতো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, এ ধরনের জালিয়াতি সংশ্লিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার ও নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের যোগসাজসেই হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ইস্যু ম্যানেজার ও অডিটরই আইপিওতে আসতে আগ্রহী কোম্পানির উদ্যোক্তাদের এমন জালিয়াতির পথ দেখিয়ে দেন। জালিয়াতি করে নেওয়া শেয়ারের একটা অংশ নানাজনের কাছে বিক্রি করেন। বাকিটা বেনামে (ভুয়া নামে) ভাগাভাগি করে নেন এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে জানান ওই মার্চেন্ট ব্যাংকার।
তিনি আরও জানান, গত ১০ বছরে আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ১০০ কোম্পানির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশিক্ষেত্রে এ জালিয়াতি হয়েছে। কমিশন তদন্ত করলে এর প্রমাণ মিলবে বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বন্ধ কোম্পানিগুলোকে সচল করার উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে। এরপর কোম্পানিটির প্রকৃত অবস্থা জানতে বিশেষ অডিটের উদ্যোগ নেয় এবং তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। ওই বিশেষ অডিট ও তদন্তে রিং শাইন টেক্সটাইলে এই জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, কমিশনের চেষ্টায় এরই মধ্যে রিং শাইন টেক্সটাইল কোম্পানিটি উৎপাদনে ফিরেছে। কোম্পানিটির শেয়ারদরে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির ধারা পর্যবেক্ষণ করছে কমিশন। অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী কোম্পানিটির প্রকৃত অবস্থা না বুঝেই শেয়ার কিনছেন। তাদের কোম্পানিটির বিষয়ে ধারণা দিতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন