ঈদের ছুটির পর কঠোর লকডাউনে রপ্তানিমুখী বস্ত্র ও পোশাক কারখানা খোলা রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। 

বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে এক বৈঠকে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের সংগঠনগুলোর নেতারা এ দাবি জানান।

বৈঠকে উদ্যোক্তারা বলেন, টানা ১৪ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে রপ্তানি আদেশ হারাতে হবে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে সংকট তৈরি হতে পারে। 

তবে বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে এ দাবির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। আগামী শনিবার এ বিষয়ে আবারও বৈঠক হবে। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, ওই বৈঠকে তাদের অনুরোধের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।

সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কারখানা খোলা রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পৃথক দুটি চিঠি দেওয়া হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। 

বৈঠকে তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সিদ্দিকুর রহমান, বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে বিজিএমইএ সভাপতি সাংবাদিকদের জানান, তারা আশাবাদী। 

তিনি বলেন, ‘সরকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কঠোর লকডাউনকালে আগের মতই বস্ত্র ও পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেবেন। কারখানা খোলা রাখা না হলে অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। করোনার প্রথম ধাক্কায় অনেক রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। সেই রপ্তানি আদেশ ফিরে এসেছে।  এছাড়া ইউরোপ এবং আমেরিকার শপিং মল এবং ব্র্যান্ডের ফ্লোর খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে চাহিদা তৈরি হয়েছে। এ সময় তারা যদি পণ্য সরবরাহ করতে না পারেন তাহলে ক্রেতারা বসে থাকবে না। তারা অন্য দেশে চলে যাবে। এছাড়া হাতে কাজ না থাকলে অনেক কারখানার মালিক দেউলিয়া হয়ে পড়বেন। কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।'

সরকার এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে শনিবারের বৈঠকে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন তিনি। 

ফারুক হাসান বলেন, ‘আগামী লকডাউনে পোশাক কারখানা বন্ধ থাকবে এমন তথ্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারের কারণে বিক্রেতারা আবার রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিতে শুরু করেছেন। ’

এ পরিস্থিতির বিষয়ে তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অবহিত করেছেন।

গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঈদের পর কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সব ধরণের শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকবে। পরদিন বুধবার রাজধানীর গুলশানে বিজিএমইএর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন উদ্যোক্তারা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চাওয়া হবে। ওই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গতকালের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। 

প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, করোনায় গত ১৫ মাসে বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্য দিয়েছে। তারপরও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা চালিয়ে রাখার স্বার্থে লোকসান দিয়েও কারখানা চালু রাখা হয়েছে। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ সব দেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ফলে প্রতিটি কারখানায় পর্যাপ্ত রপ্তানি আদেশ আছে। এমন সময়ে ঈদের ছুটিসহ ১৮ থেকে ২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে ক্রেতারা হাতছাড়া হয়ে যাবে। 

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ছুটিতে শ্রমিকরা গ্রামে যেয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরে এলে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এছাড়া ২০ দিন বন্ধের পর কারখানা খুললে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। এসব বিষয় বিবেচনায় ঈদের পর দ্রুত কারখানা খুলে দেওয়া হলে রপ্তানিমুখী শিল্প বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাবে।

চিঠিতে স্বাক্ষর করেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সভাপতি শাহাদাত হোসেন সোহেল ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান।


প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে যা আছে 

ঈদের পর কঠোর লকডাউনে পোশাক ও বস্ত্র কারখানা চালু রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে উদ্যোক্তারা লিখেছেন, দেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয়ে বস্ত্র খাত অর্থাৎ তৈরি পোশাক, টেরিটাওয়েল ও হোম টেক্সটাইলের অবদান ৮৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১৪ দিনে এ খাতের রপ্তানি আয় ১৬৭ কোটি মার্কিন ডলার। তার মানে প্রতিদিন গড়ে ১১ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের জুনের চেয়ে চলতি বছরের জুনে খাতটির রপ্তানি আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।

পাঁচ ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি লিখেছেন, করোনায় গত ১৫ মাসে বিদেশি ক্রেতারা অনৈতিকভাবে পণ্যের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্য দিয়েছেন। তারপরও বাজার ধরে রাখা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালিয়ে রাখার স্বার্থে লোকসান দিয়েও কারখানা চালানো হয়েছে। এ সময়ে অনেকেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ সব দেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ফলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের হাতে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ আছে। জাহাজীকরণে প্রচণ্ড চাপ থাকায় ক্রেতারা বলেছেন, বিলম্ব হলেই যেন উড়োজাহাজে পণ্য পাঠানো হয়। এমন সময়ে ঈদের ছুটিসহ ১৮-২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে গ্রীষ্ম, বড়দিন ও শীতের ক্রয়াদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবে। এক মাসের রপ্তানি সূচি গড়বড় হলে পরবর্তী ছয় মাসের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

চিঠিতে ব্যবসায়ীরা আরও লিখেছেন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকেরা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে কাজ করেন। দিনের অধিকাংশ সময় (মধ্যাহ্ন বিরতিসহ ১১ ঘণ্টা) কর্মক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে থাকেন তাঁরা। গত রোজার ঈদে কাজের চাপ কম থাকায় ছুটিও কিছুটা শিথিল ছিল। কিন্তু এখন কাজের প্রচুর চাপ থাকায় ঈদে লম্বা ছুটির সুযোগ নেই। কিন্তু ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ১৪ দিন, ঈদের ছুটি ৩ দিন ও ফিরে আসতে ২ থেকে ৩ দিন, অর্থাৎ মোট ১৯-২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের কর্মস্থলে ধরে রাখা যাবে না। তাঁরা ছুটে যাবেন উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেগুলো এখন করোনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ওই সব অঞ্চল থেকে কর্মস্থলে ফিরে এলে কোভিড সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ছাড়া ২০ দিন বন্ধের পর কারখানা খুললে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধ করার প্রসঙ্গ আসবে। তখন বেতন পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে ঈদের পর দ্রুত কারখানা খুলে দেওয়া হলে রপ্তানিমুখী শিল্প বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাবে।


প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া উদ্যোক্তাদের চিঠি-



মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেওয়া উদ্যোক্তাদের চিঠি-