একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আশুতোষ চক্রবর্তী। থাকেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ায়। নতুন ফ্ল্যাট হওয়ায় তার বাসায় সরকারি লাইনের গ্যাস নেই। রান্নার কাজে সিলিন্ডার গ্যাসই (এলপিজি) ভরসা। গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় গত শুক্রবার তিনি দোকানে যান সিলিন্ডার কিনতে। ৩৫ কেজির সিলিন্ডার তিনি কেনেন ৩২০০ টাকায়। ৩৫ কেজি এলপিজির সর্বশেষ সরকার ঘোষিত মূল্য দুই হাজার ৮৯৬ টাকা। সরকার ঘোষিত দামের চেয়েও ৩০৪ টাকা বেশি পড়েছে। আর দেড় মাস আগে সমপরিমাণের সিলিন্ডার তিনি কিনেছিলেন ২৮০০ টাকায়। সে হিসাবে তিনি বেশি দিয়েছেন ৪০০ টাকা।

আশুতোষ বলেন, কয়েক মাস থেকে বাড়তি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। সরকার এলপিজির মূল্য বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব নেই। সবাইকে বেশি দামেই গ্যাস কিনতে হচ্ছে। কার্যকর করতে না পারলে এমন ঘোষণার দরকার কী?

শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে না। গত এপ্রিল মাস থেকে প্রতি মাসে এলপি (তরল পেট্রোলিয়াম) গ্যাসের দাম ঘোষণা করছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু গ্রাহককে বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিইআরসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তারা শুধু দাম ঘোষণাতেই দায় সারছে।

অন্যদিকে এলপিজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের পক্ষে নির্ধারিত দাম মানা সম্ভব নয়। কারণ বিইআরসির দামে গ্যাস বিক্রি করলে লোকসান দিতে হবে।

গত ২৯ জুলাই এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গ্রাহক পর্যায়ে বেসরকারি কোম্পানির প্রতি কেজি এলপি গ্যাসের দাম ঘোষণা করা হয় ৮২ টাকা ৭২ পয়সা। এ হিসাবে আগস্ট মাসের জন্য সাড়ে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম হওয়ার কথা ৯৯৩ টাকা, যা জুলাই মাসের চেয়ে ১০২ টাকা বেশি। এরপরও বাজারে এগুলো বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকা।

রাজধানীর বছিলার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন জানান, গত সপ্তাহে তিনি সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছেন ১২০০ টাকায়।

সৌদি আরামকো কর্তৃক প্রোপেন ও বিউটেনের ঘোষিত দাম আমলে নিয়ে প্রতি মাসের শেষে আগামী মাসের জন্য এলপিজি ও অটো গ্যাসের দাম ঘোষণা করে বিইআরসি। আগামীকাল মঙ্গলবার সেপ্টেম্বর মাসের জন্য এলপিজি ও অটো গ্যাসের দাম ঘোষণা করবে সংস্থাটি। আগস্ট মাসের দাম ঘোষণার সময় এলপিজির কাঁচামাল প্রোপেন ও বিউটেন মিশ্রণের টনপ্রতি দাম ধরা হয় ৬২০ ডলার। চলতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে এই দর ৬৫৬ ডলার। ফলে সরকারি ঘোষণাতেই এলপিজির দাম বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

এক দশক আগেও অনেক বেশি দামে সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হতো গ্রাহকদের। পরবর্তীতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও সহযোগিতায় এ খাতের বাজার সম্প্রসারিত হয়। অনেক কোম্পানি এলপিজির আমদানি ও সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিনিয়োগ হয় শত শত কোটি টাকা। দামও পড়তে শুরু করে। কিন্তু এরপরও দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে থেকে যায়। গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে। এ খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে আদালতের আদেশে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গত ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো সারাদেশের জন্যই এলপিজির একই দাম বেঁধে দেয়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতি মাসেই নতুন দর ঘোষণা করে যাচ্ছে কমিশন।

ক্রেতারা বলছেন, সরকারের দাম নির্ধারণ করে কী লাভ, বাজারে তো এই দামে গ্যাস মেলে না। অন্যদিকে বিইআরসি বলছে, সারাদেশে তদারকি করার মতো তাদের জনবল নেই। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হবে।

এলপিজির খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোম্পানি যে দামে তাদের কাছে গ্যাস বিক্রি করে তাতে কমিশন যোগ করলে সরকার ঘোষিত দরে বিক্রি করা সম্ভব নয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা বারবার দাম ঘোষণার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। একাধিক বৈঠক করেছেন কমিশনের সঙ্গে। চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের মতামত রাখা হচ্ছে না। ওমেরা এলপিজির প্রধান নির্বাহী শামসুল আলম সমকালকে বলেন, দাম বাড়ছে না কমছে সেটা বিষয় নয়। মূল সমস্যা পদ্ধতিতে। যে ফর্মুলায় বিইআরসি দাম সমন্বয় করছে তাতে গলদ রয়েছে।

তিনি বলেন, এ খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। তাই একটা সমাধানে তো আসতে হবে। কারণ লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়। ব্যবসায়ীদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। তাই একটি সুষ্ঠু সমাধান প্রয়োজন।

বিইআরসি কর্তৃপক্ষ বলছে, গণশুনানি ছাড়া এলপিজি ব্যবসায়ীদের বক্তব্য শোনার সুযোগ নেই। যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা ব্যবসায়ীদের মানতে হবে। না হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে।

গত ১২ জুলাই জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এক অভিযানে বাড়তি দরে এলপিজি বিক্রির কারণে একটি অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশনকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। ওইদিনই ই-মেইলের মাধ্যমে বিইআরসিকে একটি চিঠি পাঠায় এলপিজি ব্যবসায়ীদের সংগঠন লোয়াব। চিঠিতে বলা হয়, গত ১২ এপ্রিল ঘোষিত মূল্য সংশোধনের জন্য এলপি গ্যাস অপারেটরদের ১৮টি আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া এ ধরনের অভিযান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে বিইআরসির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, তারা ব্যবসায়ীদের আবেদন পেয়েছেন। কিন্তু আইনি জটিলতায় শুনানি বন্ধ রাখতে হয়েছে।

জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, বিইআরসির ভূমিকাটা কাগজেই থাকছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে গ্রহাকদের সঙ্গে নিয়ে কমিশনকে আরও শক্তিশালী হতে হবে।

সরকারি একটি কোম্পানিসহ বর্তমানে দেশে এলপিজি আমদানি, মজুদ ও বিতরণের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে ২৯টি প্রতিষ্ঠান। বার্ষিক এলপিজি ব্যবহারের পরিমাণ ১০ লাখ টন, যার ৯৮ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। ৩৮ লাখ গ্রাহকের জন্য তিন হাজার পরিবেশক এবং ৩৮ হাজার খুচরা বিক্রেতা রয়েছে সারাদেশে।