জীবিকা রক্ষার যুক্তিতে সড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু ও ভটভটির মতো দেশীয়ভাবে তৈরি যানবাহনকে বৈধতা দিতে যাচ্ছে সরকার। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশাকেও নিবন্ধন দেওয়া হবে। কারিগরি মানোন্নয়নের শর্তে এলাকা ও সড়কভেদে এ ধরনের নির্দিষ্ট সংখ্যক যানবাহন চলতে পারবে।
এসব বিধান রেখে 'থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১-এর খসড়া করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে আগামী ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর ওপর মতামত জানানো যাবে। তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনকে বৈধতা না দিয়ে অবিলম্বে উচ্ছেদ করা উচিত।
অটোরিকশা ও অটোটেম্পোকে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নিবন্ধন দিলেও নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও পাখি নামে পরিচিত ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। হাইকোর্ট শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিনে নির্মিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু বন্ধে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি আদেশ দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশাসহ এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়।
বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক নয়, জাতীয় মহাসড়কেও দাপিয়ে চলছে অবৈধ ছোট যানবাহন। ২০১৫ সালে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এসব গাড়ি আমদানি বন্ধের প্রস্তাব উঠলেও কর্মসংস্থান রক্ষার যুক্তিতে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের বিরোধিতায় অনুমোদন পায়নি। ২০১১ সালে ইজিবাইক আমদানি বন্ধে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও উৎপাদন ও আমদানি দুই-ই চলছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা চলাচলের অনুমতি দিচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ এই ছোট যানবাহন।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, সারাদেশে নিবন্ধিত ৪৯ লাখ যানবাহনের মাত্র দেড় শতাংশ বাস ও মিনিবাস। সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনবিহীন অসংখ্য নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক, ব্যাটারির রিকশা চলছে। এসব গাড়ি কারিগরিভাবে সড়কের উপযোগী নয়। ব্রেক, স্টিয়ারিং ও সাসপেনশন মানসম্মত নয়। ফলে দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কে হতাহতের বড় অংশই এসব ছোট যানবাহনের যাত্রী। কিন্তু সাশ্রয়ী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এসব যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল।
২০১৯ সালের জুনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে 'দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি' করে বিআরটিএ। গত জানুয়ারিতে ১২ সদস্যের এই কমিটি প্রতিবেদন দেয়। এরপর নীতিমালা প্রণয়নে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি হয়।
সড়ক পরিবহন বিভাগ ও বিআরটিএ কর্মকর্তারা সমকালকে বলেছেন, সারাদেশে অটোরিকশাসহ কমপক্ষে ১৫ লাখ নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এতে অন্তত ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবিকা হয়েছে। তাই সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিবেচনায় এসব যানবাহনকে অনুমতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার। স্থানীয়ভাবে নির্ভরশীলতার কারণে বারবার চেষ্টা করেও এসব গাড়ি বন্ধ করা যায়নি। অবৈধ এসব গাড়িকে চলার সুযোগ করে দিয়ে বছরে হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। বৈধতা দিলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, সরকার রাজস্ব পাবে।
সুপারিশ প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ও সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইউছুব আলী মোল্লা সমকালকে বলেন, যেসব মতামত আসবে তা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় চূড়ান্ত হবে। হাইকোর্ট যদি বলেন 'নছিমন করিমন চলবে না'- তাহলে অনুমতি দেওয়া হবে না।
সড়কের নিরাপত্তার জন্য সাংঘর্ষিক- তা জেনেও বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ প্রসঙ্গে ইউছুব আলী বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে চালকদের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাত্রীদের সুরক্ষায় গাড়ির নকশাও অনুমোদিত হতে হবে। মহাসড়কে চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে পারলে বরং দুর্ঘটনা কমবে। তবে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, এসব যানবাহনকে বৈধতা দেওয়া আত্মঘাতী। অবৈধ অবস্থাতেই লাখে লাখে চলছে। বৈধতা পেলে আর সড়ক-মহাসড়কে ঠেকানো যাবে না। মানবিক কারণ দেখিয়ে বৈধতা দেওয়া অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। এতে সড়কে দুর্ঘটনা-প্রাণহানি বাড়বে। গতি কমবে। ফলে ব্যবসা ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সামছুল হক বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সড়ক নেটওয়ার্কে প্রবেশ করবে। এসব যানবাহন নিয়ে বাংলাদেশ কীভাবে এগোবে? ব্যবসা ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। ফলে যে কর্মসংস্থানের দোহাই দেওয়া হচ্ছে- এসব যানবাহন না থাকলে গতি বেড়ে আরও বেশি চাকরি তৈরি হবে।
খসড়া নীতিমালার ৫ ধারার উপধারায় অটোরিকশা ও অটোটেম্পোর বিষয়ে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক বাদে সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় ডিজেল কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে চলাচলে রুট পারমিট দেওয়া যাবে। অটোটেম্পো চলতে পারবে শহরের বাইরে উপজেলার নির্ধারিত সড়কে। আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি) যত সংখ্যক অটোরিকশা ও অটোটেম্পোকে রুট পারমিট দেবে, ঠিক তত সংখ্যক গাড়িকে নিবন্ধন দেবে বিআরটিএ। তার চেয়ে বেশি আমদানি ও বিক্রি করা যাবে না।
ধারা ৬-এ বলা হয়েছে, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রুট পারমিট নিয়ে চলতে পারবে। এই গাড়ির সংখ্যা নির্ধারণ করবে উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি। বেশি বিক্রি ও নিবন্ধন করা যাবে না। যাত্রী সুরক্ষার জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত নকশায় ইজিবাইক তৈরি হতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের চার্জিং নীতিমালা মেনে মানসম্মত ব্যাটারি লাগাতে হবে। সিটি করপোরেশন, বিভাগীয় ও জেলা শহরের প্রধান সড়ক বাদে আগামী দুই বছর অলিগলিতে চলতে পারবে। এরপর নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
ধারা ৭-এ বলা হয়েছে, উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক নছিমন, করিমন, আলমসাধু ও ভটভটি চলতে পারবে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। তার নকশা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত হতে হবে।

বিষয় : নছিমন করিমন ইজিবাইক

মন্তব্য করুন