- অর্থনীতি
- বিনিয়োগকারীদের মুনাফা কারসাজি চক্রের পকেটে
বিনিয়োগকারীদের মুনাফা কারসাজি চক্রের পকেটে

শহুরে অতিথিরা গ্রামে গিয়ে যেমন শখের বশে ডিঙি নৌকায় চড়ে বিড়ম্বনায় পড়েন, ঠিক যেন তেমনই অবস্থা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের। ডিঙি নৌকায় বেয়াড়া সঙ্গী যেভাবে ভারসাম্য নষ্ট করে নৌকা উল্টে দেয়; আনন্দভ্রমণকে মাটি করে ঘটায় দুর্ঘটনা; তেমনি দশা বিনিয়োগকারীদের। কারসাজি চক্রের ফাঁদে পড়ে মুনাফার আশায় লগ্নি করা বিনিয়োগকারীরা মূল পুঁজি হারাতে বসেছেন। গুটিকয় স্বার্থান্বেষী তাদের টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে।
বাজার-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গত দেড় বছরে হাতেগোনা কয়েকটি চক্র নিজেরা কেনাবেচা করে ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতে নানা গুজব ছড়িয়ে দর বাড়িয়েছিল। এর কেন্দ্রে একজন সরকারি কর্মকর্তা। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও প্রলুব্ধ হয়ে যখন শেয়ার কিনেছেন এবং দর বেড়েছে, তখন ওই চক্র তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে ক্রমাগত দর হারাচ্ছে শেয়ারগুলো।
বাজার সূত্র জানায়, এ চক্রটি বীমা কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে গত বছর জুলাইয়ে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করেছিল। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হন। পরে সাধারণ ছোট মূলধনি ও কম বাজারদরি অন্য অনেক শেয়ারের দর বাড়িয়ে মুনাফা নিয়ে সটকেও পড়েছে। কিছুদিন আগে এ চক্রের হাতে পড়ে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দর মাত্র তিন সপ্তাহে ১২ টাকা থেকে ২০ টাকা ছাড়িয়েছিল। চক্রটি মুনাফা নিয়ে বের হওয়ায় যেভাবে শেয়ারটির দর বেড়েছিল, ঠিক সেভাবে দাম কমে আগের জায়গায় ফিরেছে। এর আগে ১০ টাকা দরের এনআরবিসির মতো নতুন ব্যাংকের শেয়ারদরও ৪০ টাকায় তুলেছিল। গত নভেম্বরের শুরুতেও শেয়ারটির দর ৪০ টাকা ছিল; এখন যা ২৫ টাকায়। এ চক্রের হাতে এখনও ফরচুন শুজ, জেনেক্স ইনফোসিস, ডেল্টা লাইফ, সোনালী পেপারের শেয়ার রয়েছে। এখন এসব শেয়ারই নিজেরা সার্কুলার ট্রেড করে শেয়ার লেনদেন বাড়িয়ে রেখেছে। গতকাল ডিএসইতে ৮৮৫ কোটি টাকার লেনদেনে এ চক্রেরই ৩০ শতাংশ লেনদেন ছিল।
কারসাজি চক্রের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আচরণও বাজারে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরের শেষে এসেও ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যতটা সম্ভব মুনাফা বাড়াতে শেয়ার বিক্রি করেছে; এর পর হাত গুটিয়ে বসে আছে। এই বসে থাকার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ইস্যুর প্রভাব আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ ব্যাংককে শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে ব্যাংকের বিনিয়োগে খুব বেশি খবরদারি না করা। নানা রকম ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শেয়ারবাজারের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টাও আছে।
শেয়ারবাজার বিশ্নেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আল আমীন বলেন, এ বাজারে ১০ লাখের বেশি সক্রিয় বিনিয়োগকারী থাকলেও হাজার জনকেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, যারা নিজের বোধ-বুদ্ধি ব্যবহার করে শেয়ার কেনেন। এরা কারসাজি চক্র কী শেয়ার কিনছে, তা দেখে শেয়ার কেনেন। প্রতিষ্ঠানগুলোও তাই। এখন বড়রা নিষ্ফ্ক্রিয় থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কোন শেয়ার কিনবেন, কোনটা বিক্রি করবেন- এ দিশা পাচ্ছেন না। এ কারণে কয়েক মাস ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করছে শেয়ারবাজার। হঠাৎ বড় উত্থান হচ্ছে, পরদিনই বড় পতন হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পতনই হচ্ছে বেশি।
যেমন গতকালও বড় দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে কেনাবেচা হওয়া ৩৭৮ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩০০টিই দর হারিয়েছে। এতে এক দিনেই বাজার মূলধন বা সব শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে ৫ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। শুধু গতকাল নয়; গত ৯ সেপ্টেম্বরের পর বাজার মূলধন কমেছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে ৩৪৫ শেয়ারের মধ্যে ২৬৭টি এবং ৩৭ মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৬টির ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দর কমেছে। কমপক্ষে ২০ শতাংশ দর কমেছে ১৫৩টির।
এমন দরপতনের পরও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম মনে করেন, এটা স্বাভাবিক। তিনি বলেন, কখনও শেয়ারদর বাড়বে, কখনও কমবে- এটাই শেয়ারবাজারের ধর্ম। তার মতে, সাম্প্রতিক দর কমার কারণ তিনটি। প্রথমত, বছর শেষে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নেওয়া; দ্বিতীয়ত, মার্জিন ঋণ সমন্বয়ের জন্য নতুন করে তহবিল ছাড় হ্রাস পাওয়া এবং তৃতীয়ত, কয়েকটি আইপিও আসা। তিনি আশা করছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। গত রাতে সমকালকে তিনি বলেন, শেয়ারবাজার সূচক পড়লে অনেকে ভীত হন। এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থার চিন্তার বিষয় নয়। এটা স্টক এক্সচেঞ্জ দেখবে। তবে হ্যাঁ, গুরুতর কিছু হলে অবশ্যই বিএসইসি দেখবে।
কিন্তু শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিরই সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী মনে করেন, বাজার এখন ঠিক নেই। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেভাবে শেয়ারদর ও সূচক বেড়েছে, তার যৌক্তিক কোনো কারণই ছিল না। কৃত্রিমভাবে বাড়ানো শেয়ারদর টেকসই হয় না।
তিনি বলেন, কখনও দায়িত্বশীল সংস্থা থেকে ব্যাংককে বিনিয়োগ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কখনও বলা হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার হিসাব করতে; কখনও অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে বলে প্রচার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ ভালো। দায়িত্বশীলরা আগ বাড়িয়ে কথা বলায় বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এসব যদি বাদ দেন, তাহলে এই দরপতনের আগে যে শেয়ারদর বেড়েছিল, তার যৌক্তিক কি কোনো কারণ ছিল?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, যখনই বাজারকে কৃত্রিমভাবে বাড়তে দেওয়া হয়, তখনই কারসাজি জেঁকে বসে। গত দেড় বছরের শেয়ারবাজারের উত্থানে ভালো শেয়ারের দর তুলনামূলক কম বেড়েছে। কারণ দামি ও বড় শেয়ারের দর বাড়ানো সহজ ব্যাপার না। তাই খারাপ শেয়ারের দাম বেড়েছে বহু গুণ। এটা যে কারসাজির মাধ্যমে হচ্ছে, তা স্পষ্ট। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়তো গুরুত্ব দিচ্ছে না।
বিএসইসির সাবেক এ চেয়ারম্যান আরও বলেন, বলা হয়, কারসাজি ধরার জন্য 'স্টেট অব দ্য আর্ট' টেকনোলজির সফটওয়্যার আছে। তাহলে ওটা দিয়ে কী করা হচ্ছে? বিএসইসির উচিত ওই সফটওয়্যার দেখে কারা কারসাজি করছে, কোন ব্রোকারেজ হাউস থেকে কারসাজি করছে, তাদের খুঁজে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তা না হলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে এবং বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারাতেই থাকবেন। তাই সূচক বা লেনদেন কোথায় গেল, তা না দেখে সবাই আইন মেনে শেয়ার কেনাবেচা করছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে কমিশনকে সর্বশক্তি নিয়োগের পরামর্শ দেন তিনি।
সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো অবশ্য জানায়, শেয়ারবাজার এখন পুরোপুরি কৃত্রিমভাবে চলছে। কমিশনের জ্ঞাতসারেই এটা হচ্ছে। এখনকার লেনদেনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে গুটিকয় ব্যক্তি ও তাদের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে। তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করে লেনদেন বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো কারসাজি চক্র বেপরোয়া। তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা জড়িয়ে পড়েছেন কারসাজিতে। অনেক প্রভাবশালীও শেয়ার কেনাবেচা করছেন। এসব জেনেও কী করে তা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তা না করে উল্টো কারসাজি চক্রের হাতে একের পর এক ব্রোকারেজ লাইসেন্স তুলে দিচ্ছে বিএসইসি। গত দেড় বছরে তিনটি ব্রোকারেজ প্রায় ২০০ কোটি টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে।
তবে কমিশনের কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েও কারসাজি চলছে। যেমন উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নূ্যনতম শেয়ার থাকা, অযথা বোনাস লভ্যাংশ প্রদান নিরুৎসাহিত করা, বন্ধ কোম্পানির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন নূ্যনতম পর্যায়ে উন্নীত করা। কমিশনের এসব সিদ্ধান্তকে পুঁজি করে আবার কেউ কেউ কারসাজির ফাঁদও পাতছে। এসব জেনেও কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাদের ভয়- ব্যবস্থা নিতে গেলে বাজারে আরও দরপতন হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান সমকালকে বলেন, কারসাজির কথা উঠলে এখন একজনের কথা অনেক বেশি শোনা যায়। অভিযোগ পেয়ে তাকে কমিশন কার্যালয়ে ডেকেছিলাম। সে নিজে এবং আত্মীয়স্বজনের নামে যে শেয়ার কেনাবেচা করে, তা দিয়ে কারসাজি প্রমাণ করা যায় না। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
মন্তব্য করুন