করোনা মহামারির কারণে এখনও দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে ওমিক্রণের সংক্রমণে আবারও ব্যবসা-বাণিজ্যে নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ীর ঋণের কিস্তি দেওয়ার সক্ষমতা নেই। ঋণের কিস্তি দেওয়ার সময় না বাড়ালে অনেকেই খেলাপি হবেন, যা দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধার সময় অন্তত জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সারাদেশের ব্যবসায়ী নেতারা।

শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই আয়োজিত কাউন্সিল অব চেম্বার প্রেসিডেন্টস-২০২২ এর মতবিনিময় সভায় এই দাবি জানান তারা। সভায় বক্তব্য রাখেন সারাদেশ থেকে আগত জেলা, সিটি ও নারী উদ্যোক্তাদের চেম্বারগুলোর সভাপতি ও সহ-সভাপতিরা।

ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা দরকার। তা না হলে, ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে। ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধার মেয়াদ না বাড়ালে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি হবেন।

তিনি বলেন, মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তারা। কিন্তু এ খাতে দ্বিতীয় পর্যায়ে যেই ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার তার ২০ শতাংশ ঋণও পাননি উদ্যোক্তারা। ছোটদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর অনীহা রয়েছে। বড় গ্রাহকদের ঋণে খেলাপির ঝুঁঁকি বাড়ে। খেলাপির ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই বড় গ্রাহকদের। ব্যাংকগুলো মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ঋণ দিচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। অথচ এসএমই খাতে খেলাপি ঋণ নেই বললেই চলে।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের আত্মীয় কিংবা পরিচিতদের প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ দিচ্ছে। ফলে যাদের ঋণ দরকার নেই তারাও ঋণ পাচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুসন্ধান করতে হবে।

ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাড়াহুড়ো করে ভ্যাট আইন করা ঠিক হবে না। ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করে ব্যবসাবান্ধব আইন করতে হবে। যা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ডিসি সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, অর্থনীতিতে ব্যবসায়ীদের অবদান ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করে ব্যবসা করতে হচ্ছে। ব্যবসা শুরু করতে গেলে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। এতে অনেক সময় লেগে যায়। কিন্ত ডিসি সম্মেলনে এফবিসিসিআইকে ডাকা হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীদের সমস্যা তুলে ধরা সম্ভব হয়নি।

সভাপতির বক্তব্যে কাউন্সিল অব চেম্বার প্রেসিডেন্টস সভাপতি ও এফবিসিসিআই'র সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, এখনও শুল্ক-কর ও ভ্যাট আদায়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কোম্পানি আইন, আমদানি ও রপ্তানি আইন যেন ব্যবসা বান্ধব হয়।

ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, মধ্য ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আলাদা নীতিমালা করতে হবে। এছাড়া ভ্যাট ও আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে অটোমেশন করার দাবি জানান তিনি।

এমসিসিআইর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, করোনায় ৩৭ লাখ লোক কাজ হারিয়েছেন। সামনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসছে। এতে বেশিরভাগ উৎপাদন প্রক্রিয়া অটোমেশন বা রোবটিক পর্যায়ে চলে যাবে। তখন বহু লোক চাকরি হারাবে। এদের কীভাবে কাজে লাগানো হবে সেই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

জেলা পর্যায়ে যেসব সম্ভাবনাময় ব্যবসাখাত রয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। এছাড়া ব্যবসায় লাভ বা লোকসান যা-ই হোক না কেন ব্যবসায়ীদের কর দিতে হচ্ছে। এটা অযৌক্তি। তাই কর আইনের ৩৩ ধারার সংশোধনের দাবি জানান তিনি।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার দাবি জানিয়েছেন কপবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ছোট উদ্যাক্তাদের অনেক ইচ্ছা বা সক্ষমতা থাকার পরও তারা ব্যবসা প্রসার করতে পারছে না।

নীলফামারি চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি ফারহানুল হক, টাঙ্গাইল চেম্বারের সভাপতি খান আহমেদ শুভ ও বান্দরবান চেম্বারের সহ-সভাপতি লক্ষীপদ রায় বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের ছোট ব্যবসায়ীরা কোনো প্রণোদনা ঋণ পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এফবিসিসিআইকে অনুরোধ জানান তারা।

জেলা চেম্বারের সভাপতিদের একটা পদমর্যাদা নির্ধারণের দাবি জানান সাতক্ষিরা চেম্বারের সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু। তিনি বলেন, ডিসিদের কী বলে সম্বোধন করবো বা ডিসি অফিসে গিয়ে কোথায় বসবো তা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার।

এফবিসিসিআইর পরিচালক রেজাউল করিম রেজনুসহ জেলা চেম্বারের সভাপতিরা এফবিসিসিআই সভাপতির পদমর্যাদা প্রতিমন্ত্রীর সমান করার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলে তিনি সরাসরি ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন।