আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের অস্থিরতার কারণে কৌশলে ফায়দা লুটছেন কিছু ব্যবসায়ী। বাড়তি দামের আশায় বিক্রি কমিয়ে মজুত করছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী। আবার কোনো কোনো কোম্পানি তেল বিক্রিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে অন্য পণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের অভিযানে এসব অনিয়ম উঠে এসেছে।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কয়েকটি ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানি ও পাইকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে দেখা গেছে, তারা তেল বিক্রিতে পাকা রসিদ ব্যবহার করছে না। কার কাছে তেল বিক্রি করছে, তার কোনো নাম-ঠিকানাও থাকছে না। এদিকে পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো পাইকারি ক্রেতাদের যে সরবরাহ আদেশ দিচ্ছে, সেখানে কোনো ইউনিট মূল্য অর্থাৎ লিটার বা মণপ্রতি দাম উল্লেখ করছে না। এটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে, কোম্পানিগুলো তাদের কারখানায় মজুত কম দেখাতে বা তেল সরবরাহ করা হচ্ছে প্রমাণ করতে-কাগজে কলমে বিক্রি দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিক্রি করছে না। কারখানা বা গুদাম থেকে তেল বের করতে নাম ঠিকানা ও ইউনিট মূল্যবিহীন রসিদে নিজস্ব লোকের কাছে তেল পাঠানো হচ্ছে। এতে তেল এক জায়গায় মজুত না হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মজুত করা হচ্ছে। এ কারণে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে, কোথাও পাকা রসিদ ও ইউনিট মূল্য ছাড়া সরবরাহ আদেশের বিপরীতে তেল পাওয়া গেলে সেগুলো যাতে আটক করা হয়।
কর্মকর্তারা আরও জানান, বাজার তদারকির সময় দেখা গেছে, একটি কোম্পানি সয়াবিন তেলের ৫ লিটারের বোতলের সঙ্গে দুই কেজি সুগন্ধি চাল কেনার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আরেকটি কোম্পানি ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের সঙ্গে ৪০০ গ্রামের চা কেনার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এটা ক্রেতাকে পণ্য কেনায় বাধ্য করা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে যাতে কোনো কোম্পানি ক্রেতাদের পণ্য কিনতে বাধ্য করতে না পারে, সে জন্য সব জেলা প্রশাসক ও সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোজ্যতেলের বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য মাঠ পর্যায়ে অভিযানসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অভিযানে ব্যবসায়ীদের কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে। অনিয়ম বন্ধে অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সংগঠন, জেলা প্রশাসক ও বিভিন্ন কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আবার ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজিসহ কিছু সমস্যার কথা বলেছেন। এ সমস্যা সমাধানের জন্যও সংশ্নিষ্ট পক্ষগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের শেষভাগ থেকে সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত সয়াবিনের এক লিটার বোতলের ১৬৮ টাকা, ৫ লিটারের বোতলের দাম ৭৯৫ টাকা এবং খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর পাম তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত দরে বিক্রি হলেও খোলা সয়াবিন ও পাম তেল বিক্রি হচ্ছে বেশি দরে। এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা এবং ৫ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৭৯০ থেকে ৮৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা সয়াবিন তেল সব জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না। আর পাম তেল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা দরে।

ব্যবসায়ীরা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণের প্রস্তাব করে। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাড়তি দামের প্রস্তাবে সায় দেয়নি। এরপর থেকে বাজারে তেলের সরবরাহ কমে গেছে। অথচ কোম্পানিগুলোর কাছে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এদিকে দাম নিয়ন্ত্রণে এবং বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য সরকার ভোজ্যতেলের স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। আর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১০ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি এলসি মার্জিন শূন্য করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
গত ৬ মার্চ ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন কোন কোম্পানির কাছে কী পরিমাণ তেল আছে, তার একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। ওই প্রতিবেদেন দেখা গেছে, সমিতির সদস্য ৬ কোম্পানির কাছে বর্তমানে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৩৬ টন ভোজ্যতেল মজুত রয়েছে। এর মধ্যে পরিশোধিত ১৯ হাজার ৭৩৭ টন এবং অপরিশোধিত ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৯ টন।
আর আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ টনের। বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বছরে মোট ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে।
এতে মাসে গড়ে দেড় লাখ টনের কিছু বেশি ভোজ্যতেল দরকার পড়ে।