আর্থিক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে প্রতারণাও। মোবাইলে আর্থিক সেবা নিতে গিয়ে যারা প্রতারিত হয়েছেন, তাদের গড় ক্ষতি হয়েছে ৯ হাজার ২১৯ টাকা। আর প্রতারণার শিকার এজেন্টের গড়ে ক্ষতি হয়েছে ১৮ হাজার ৯৮৪ টাকা করে। উভয় ক্ষেত্রে শহরের মানুষ বেশি প্রতারিত হয়েছেন। প্রতারণা ঠেকাতে আর্থিক শিক্ষা প্রসারে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা, ডিজিটাল প্রতারণা ঠেকানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ব্যবহারকারীর সচেতনতা।

গতকাল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপ পরিচালনায় সহায়তা করেছে ফ্রেডরিক নাউম্যান ফাউন্ডেশন (এফএনএফ)। 'দ্য স্টেট অব ডিএফএস কনজ্যুমার প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন পিআরআইর সিনিয়র ইকোনমিস্ট ড. আশিকুর রহমান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পিআরআইর চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার। জরিপে দেশের ৯ হাজার ২৭৯ জন অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫ জেলার সাত হাজার ২৭৯ জন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ব্যবহারকারী। আর ১৩ জেলার দুই হাজার এজেন্ট।

জরিপে অংশগ্রহণকারী এমএফএস ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৯ দশমিক ৩ শতাংশই বিভিন্ন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। গ্রাহকের একটি প্রতারণায় সর্বোচ্চ ২৫ হাজার এবং সর্বনিম্ন দেড় হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর এজেন্ট সর্বোচ্চ ৭০ হাজার এবং সর্বনিম্ন এক হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন। প্রতারণার শিকার ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই পিন নম্বর অন্যদের জানিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ৩০ শতাংশ প্রতারণার শিকার হয়েছেন সিলেট বিভাগের মানুষ। আর সর্বনিম্ন ৬ শতাংশ প্রতারণার শিকার হয়েছেন ঢাকা, বরিশাল ও ময়মনসিংহের মানুষ। গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষ বেশি প্রতারিত হয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী এজেন্টদের মধ্যে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রতারণার শিকার এজেন্টদের মধ্যে ৭৪ শতাংশের ক্ষেত্রেই অন্যের সঙ্গে পিন শেয়ার করেছেন। এ ক্ষেত্রে গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষ বেশি প্রতারিত হয়েছেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, দেশ যত বেশি ডিজিটাইজড হবে, অপরাধী তত আধুনিক হবে। ফলে প্রযুক্তিভিত্তিক অপরাধ মোকাবিলা করতে হবে প্রযুক্তির ব্যবহার করে। তিনি বলেন, একজনের নামে ১৫টি সিম নিবন্ধনের সুযোগ নিয়ে অনেকে প্রতারণা করছেন। তবে এটা বন্ধ করতে গেলেও দেখা যাবে অনেকে সমস্যায় পড়ছেন। তিনি বলেন, যে কোনো অপরাধ প্রতিরোধ করতে পদ্ধতিকে ত্রুটিমুক্ত ও নিরাপদ রাখতে হবে।

সমাপনী বক্তব্য দেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, চাই বা না চাই, সবকিছু ডিজিটাল হবেই। আশির দশকে যেমন বিশ্বায়ন নিয়ে বলা হতো। ফলে এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সামনে এগোতে হবে। জালিয়াতি বন্ধে সবার মধ্যে সচেতনতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আরও সক্রিয় হতে হবে। ডেস্কে বসে শুধু আইন করলে হবে না। তা ঠিকমতো পরিপালন হচ্ছে কিনা, দেখতে হবে। ভোক্তা বা এজেন্টের দিক থেকে যে কোনো অভিযোগ পাওয়ার পর তা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে। আর্থিক শিক্ষা প্রসারে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচেতনতা তৈরির কাজ করতে হবে।

বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির বলেন, প্রতারকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে। এ ক্ষেত্রে তারা নতুন নতুন কৌশল নিয়ে আসে। ফলে প্রতারণা বন্ধে গ্রাহক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ কাজটি বিকাশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্মিলিতভাবে সবাইকে সচেতনতা তৈরির কাজ করতে হবে।

এফএনএফের বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার কান্ট্রি ডিরেক্টর উলফগ্যাং হেইঞ্জ বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের জালিয়াতি সারাবিশ্বেই ঘটছে। এটা রোধে বিশ্বের অনেক দেশে এখন আলাদা আইটি নিরাপত্তা দল ও পুলিশ ফোর্স রয়েছে।
গবেষক খন্দকার সাখাওয়াত আলী বলেন, এখানে একটা ভালো দিক যে সবাই সমস্যা স্বীকার করছেন। এটা ঠেকাতে সচেতনতার পাশাপাশি এমএফএসের খরচ কমাতে হবে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সোনিয়া বশির কবির বলেন, কোনো জালিয়াতি হলে তার দায় সবাইকে নিতে হবে। প্রতারণা ঠেকাতে ডিজিটাল শিক্ষা এবং আর্থিক শিক্ষার প্রসারের বিকল্প নেই।