বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। সংস্থাটি বলেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ বাজেট। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যা তাতে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া এবং নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প চালু রাখা ঠিক হবে না।

মঙ্গলবার আগামী বাজেটের জন্য আনুষ্ঠানিক সুপারিশমালা উপস্থাপন করে সিপিডি। রাজধানীর ধানমন্ডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ অন্য গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।

সিপিডি বলেছে, বাজেটে গরিব ও প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো এবং সমাজের বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ থাকতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিতে শুল্ক্ক ছাড় দিতে হবে। ব্যক্তি শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। প্রশ্নোত্তর পর্বে এ বিষয়ে একই মতামত দেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও তৌফিকুল ইসলাম খান। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ বাজেট। এমন সময়ে সরকার সাধারণত রাজনৈতিক বিবেচনায় জনসন্তুষ্টির প্রকল্প নিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ নেই। তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচনের আগে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কিছু প্রকল্প নেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। অনেক প্রকল্প এক বা দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে চালু রাখা হয়। এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন সতর্ক থাকা দরকার। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না।

সিপিডির উপস্থাপনায় বলা হয়, আগামী অর্থবছরের বাজেট আসছে এমন সময়ে, যখন নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে চলেছে। অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বাজেটের মূল দর্শন হওয়া উচিত প্রান্তিক মানুষের কল্যাণ, আয়ের সমবণ্টন এবং বৈষম্য কমিয়ে আনা। এ ছাড়া বহিঃখাত প্রচণ্ড চাপে রয়েছে। বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। এজন্য রাজস্ব সংগ্রহ নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে না রেখে বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। পাশাপাশি অর্থ পাচার রোধে উদ্যোগ জোরদারের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে এমন সব উদ্যোগ দরকার যাতে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে। কৃষি উৎপাদন খরচ কম হয়। এজন্য সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে। তিনি রপ্তানি প্রণোদনা কাঠামো পুনর্বিবেচনা করা এবং করোনার কারণে দেওয়া কর অবকাশ ও রেয়াত দেওয়া তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর হওয়ার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ও পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। সরকারকে কঠোর হাতে এসব বন্ধ করতে হবে।

সমাজে বৈষম্য কমানো এবং প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে সিপিডি ব্যক্তি শ্রেণির করের সর্বোচ্চ হার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে। পাশাপাশি ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া এক ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা, সিগারেটে শলাকাপ্রতি কর নির্ধারণসহ আয়কর বিষয়ে আরও কিছু প্রস্তাব করে।

সিপিডির প্রস্তাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়ানো, একই ধরনের কর্মসূচি এক জায়গা থেকে পরিচালনা, শহরের দরিদ্রদের জন্য বাজেটে উদ্যোগ এবং সার্বজনীন পেনশনের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন থেকে সব ধরনের শুল্ক্ক প্রত্যাহার, ওষুধে ভ্যাট তুলে নেওয়া, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিউশন ফি থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার, সবুজ উদ্যোগে প্রণোদনা দেওয়া এবং যারা সবুজ কার্যক্রমে যাবে না তাদের ওপর বাড়তি করারোপ করা এবং হাইব্রিড গাড়ি আমদানিতে কর ছাড়ের প্রস্তাব করেছে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যতিক্রম সময়ে বাজেট আসছে। এজন্য উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিতে হবে। কীভাবে নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যায়, সেজন্য বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন ইকোনমিক সোশ্যাল অর্ডার প্রয়োজন। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। সরকারের ঋণ ও দায়, বাজার, সুশাসন, প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং রাজস্ব আদায় কাঠামো বিষয়ে বিশেষ নজর দরকার।