আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। মোট রাজস্বের ৩৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আগামী অর্থবছরে সরকার মোট ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে চায় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার ৩৫ শতাংশ বা এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আয়কর থেকে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ বা এক লাখ কোটি টাকা বা আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ের রাজস্ব থেকে সংগ্রহের প্রাক্কলন করা হচ্ছে। আর বাকি এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা বা এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ শতাংশ আসবে স্থানীয় পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) থেকে।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে সরকারের ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে আয়কর থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা ছিল এক লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা বা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের ভ্যাট থেকে এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ের রাজস্ব থেকে ৯৬ হাজার কোটি টাকা ২৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ রাজস্ব সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এনবিআর এক লাখ ৭৬ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা কর রাজস্ব সংগ্রহ করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।

এনবিআর-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের দেশে দেশে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। করোনাপরবর্তী বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও রাসায়নিক পণ্যের দাম বেড়েছে। শিগগিরই এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যাবে না বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা। এ পরিস্থিতিতে দেশে মূল্যস্ম্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, বৈষম্য কমানো, মানুষের আয় বাড়ানো এবং প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হচ্ছে। সে জন্য আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ বাড়াচ্ছে সরকার। কিন্তু ভর্তুকি দিতে যে অর্থ লাগবে, তা সংগ্রহ করতে সরকার প্রত্যক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।

এনবিআরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ ধারণা পাওয়া গেছে, আয়করের হারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। তবে যেসব জায়গা থেকে আয়কর সংগ্রহের সুযোগ আছে, তার পুরোটাই কাজে লাগানো হবে। গাড়ি, জমি, ভবন, ফ্ল্যাট নিবন্ধন খাত থেকে বেশি রাজস্ব সংগ্রহের পরিকল্পনা চলছে। জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে যাতে কর সংগ্রহ বাড়ানো যায়, সে উদ্যোগ বেগবান করা হবে। ভ্রমণ খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহও বাড়বে বলে আশা করছে এনবিআর। এগুলো প্রত্যক্ষ করের মধ্যে পড়ে। তবে করমুক্ত আয়সীমাতে ছাড় দেওয়া হতে পারে। ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বর্তমানে ৩ লাখ টাকা। আগামী বাজেটে এ সীমা বাড়ানো হতে পারে অথবা আয়করের স্লাবে পরিবর্তনের মাধ্যমে ছাড় দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে ৭৮ লাখ টিআইএনধারী আছেন। তাদের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন প্রায় ৩৫ লাখ।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো বা স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা না চাপানোর বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, সামষ্টিক বাজেট নিয়ে বেশ কাজ হয়েছে। করমুক্ত আয়সীমার মতো বিষয়ভিত্তিক ইস্যুতে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সরকার মানুষের কষ্ট, ভোগান্তি যাতে না বাড়ে সে রকম বাজেট প্রণয়ন করবে। কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের বোঝা বাড়ানো হবে না।

এদিকে ভোগ্যপণ্য ও নিত্যদিনের ব্যবহার্য পণ্য ও সেবায় ভ্যাট কমিয়ে ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) ব্যবহার বাড়ানো হবে। ভোজ্যতেল, চিনি, চাল আমদানিতে যে শুল্ক্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে আমদানি পর্যায় থেকে রাজস্ব বাড়বে। কারণ আগামীতেও আমদানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।
জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সমকালকে বলেন, প্রত্যক্ষ কর অবশ্যই বাড়াতে হবে। প্রত্যক্ষ কর ঠিকমতো আদায় না হওয়ায় সমাজে বৈষম্য বেড়ে যায়। যার কর দেওয়ার কথা তিনি দিচ্ছেন না বা যতটুকু দেওয়ার কথা, তার চেয়ে কম দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতির উন্নতি করা সম্ভব হলেই প্রত্যক্ষ কর বাড়বে। তবে জোর করে কর সংগ্রহ করা উচিত হবে না। কর সংগ্রহের জন্য পদ্ধতিগত উন্নয়ন করতে হবে।