ভোজ্যতেল নিয়ে দেশে একের পর এক নোঙর করছে জাহাজ। চার জাহাজে চেপে এ মাসেই প্রায় তিন কোটি ৬৩ লাখ লিটার সয়াবিন ও পাম অয়েল এসেছে। এর আগের চার মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৫৮ কোটি ৭৫ লাখ লিটার ভোজ্যতেল খালাস করেছেন আমদানিকারকরা। এ হিসাবে গতকাল রোববার পর্যন্ত ভোজ্যতেল এসেছে ৬২ কোটি ৩৮ লাখ লিটার। তবু দুই মাস ধরে চাহিদামতো ভোজ্যতেল মিলছে না বাজারে। রমজানে শুরু হওয়া এ সংকট এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। জাহাজে জাহাজে এত ভোজ্যতেল দেশে ঢোকার পরও সংকট থাকায় প্রশ্ন উঠছে, এই তেল যাচ্ছে কোথায়?

বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন বা ২০০ কোটি লিটার। রমজানে চাহিদা কিছুটা বাড়লেও প্রতি মাসে গড় চাহিদা থাকে দেড় লাখ টন বা ১৫ কোটি লিটার। আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে তেলের দাম আগের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকলেও এ বছর এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ তেল এসেছে, তাতে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকার কথা। বাজারে দেখা যাচ্ছে উল্টো ছবি। নতুনভাবে বাড়তি দাম নির্ধারণের পরও মিলছে না তেল।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গেল চার মাসে যে পরিমাণ তেল আমদানি হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই সঙ্গে সঙ্গে খালাস করে ফেলেন ব্যবসায়ীরা। এ মাসের প্রথম সাত দিনে ট্যাঙ্ক টার্মিনালে ২৫ লাখ লিটার তেল রাখেন তারা। একই সময়ে খালাসও করে ফেলেন ২৫ লাখ লিটার তেল। সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আগেভাগে জানতে পারায় আমদানি করা সব তেল খালাস করেন ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক সময়ে এসব টার্মিনালে অন্তত এক কোটি লিটার তেল সংরক্ষিত থাকে। এখন টার্মিনালগুলোতে আপৎকালীন তেলও নেই।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার সালাউদ্দিন রিজভী জানান, বন্দরে আসা ভোজ্যতেল প্রথমে সংরক্ষণ করা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের আওতায় থাকা ৮৮টি বন্ড টার্মিনালের ট্যাঙ্কারে। শুল্ক্ক পরিশোধের পর এসব ট্যাঙ্কার থেকে তেল পরিশোধন কারখানায় নিয়ে যান আমদানিকারকরা। সেখান থেকে পরিবেশকের মাধ্যমে তা বাজারে সরবরাহ করা হয়।

দেশে ভোজ্যতেল আমদানি করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, টি কে গ্রুপ, বসুন্ধরা ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল। পাইকাররা বলছেন, আমদানিকারকরাই অবৈধভাবে মজুত করে এই সংকট তৈরি করছেন। নির্দিষ্ট ডিলারদের দিয়ে সয়াবিন তেল সীমিত আকারে সরবরাহ করছেন তারা। এ জন্য মিলগেটেও চাহিদামতো ভোজ্যতেল মিলছে না। এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকেই চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না তারা। পাইকারদের বিরুদ্ধে তেল মজুত করার অভিযোগ তুলছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। বেশ কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে বাজারে চাহিদামতো ভোজ্যতেল সরবরাহ না হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কয়েকজন পাইকারের গুদামে তেল মজুত থাকার প্রমাণও মিলেছে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে তেলের দাম বাড়তি। এ জন্য কেউ কেউ এলসি কমিয়ে দিয়েছেন। যে পরিমাণ তেল এসেছে, দেশে তাতে সংকট হওয়ার কথা নয়। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখন যদি কেউ তেল মজুত করে রাখে, তাহলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে।'

ভোজ্যতেলের শীর্ষ এক আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সর্বশেষ যে জাহাজটি এসেছে, সেটিতে আমাদের প্রতি টন তেলের দাম পড়েছে প্রায় দুই হাজার মার্কিন ডলার। আগের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে এই জাহাজের তেল। তারপরও তেল আমদানি স্বাভাবিক রেখেছি আমরা। ঈদের ছুটির কারণে উৎপাদন প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যাহত হলেও এখন সেটিও স্বাভাবিক হয়েছে। স্বাভাবিক আছে সরবরাহ প্রক্রিয়াও।' ভোজ্যতেল সরবরাহে মিলগেটে কোনো সংকট নেই বলে জানান তিনি।

আমদানি ও খালাস হয়েছে বিদ্যুৎ গতিতে :এ বছরের শুরু থেকেই ভোজ্যতেলের আমদানি ও খালাস কার্যক্রমে ছিল বিদ্যুৎ গতি। জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের বন্ড টার্মিনালে ৯১ হাজার ৩০০ টন ভোজ্যতেল রাখা হয়। একই মাসে খালাস করা হয় ১ লাখ ২৮ হাজার ৯২৫ টন তেল। ওই মাসে আমদানির চেয়ে ৩৭ হাজার টন ভোজ্যতেল বেশি খালাস করে ব্যবসায়ীরা। ফেব্রুয়ারিতেও অভিন্ন ছিল খালাসের ছবি। ১ লাখ ৭২ হাজার ৬১০ টন ভোজ্যতেল বন্ড টার্মিনালে রাখলেও ওই মাসে তারা খালাস করে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮১৮ টন ভোজ্যতেল। তবে মার্চে খালাস কার্যক্রমে দেখা যায় কিছুটা ধীরগতি। এই মাসে ১ লাখ ৭৫ হাজার টন ভোজ্যতেল টার্মিনালে ঢুকলেও খালাস হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার টন। তবে এ মাসের প্রথম সাত দিনে আবার সমানে সমান ছিল আমদানি ও খালাস প্রক্রিয়া।

ট্যাক্স-ভ্যাটে ছাড়ের পরও কেন মিলছে না সুফল :জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই দফায় প্রজ্ঞাপন জারি করে সয়াবিন ও পাম অয়েলের ওপর থেকে আমদানি পর্যায়ের ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়েছে। সেই সঙ্গে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। তবে এর সুফল পাননি ভোক্তারা।

ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার ছুতায় ভোজ্যতেল নিয়ে মনোপুলি ব্যবসা করছেন কিছু ব্যবসায়ী। যে পরিমাণ ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে, তাতে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার কথা। বাজারে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট কেন তৈরি করা হলো? সরকার ভোক্তার সুবিধার্থে ট্যাক্স-ভ্যাটে ছাড় দিয়েছে। এখন আবার নতুন করে ছাড় চাইছেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য সরবরাহ কমিয়ে সংকটকে দীর্ঘায়িত করছেন তারা। শীর্ষ আমদানিকারকদের পণ্য খালাস কার্যক্রম তদারকি করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।'