
অতিবৃষ্টির কারণে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, যাতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারায়। বন্যার ভয়াবহতা এমন ছিল যে আমাদের দেশজ উৎপাদন কমে যায়। বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে সে সময় প্রায়ই দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় মার্কেট ভিজিটে যেতে হতো এবং আমি দেখতে পেতাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা। পরে ইউনিলিভারে গত ২২ বছর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও মহাদেশে কাজ করার সুবাদে আমি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আরও ভালোভাবে জানা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি। সবকিছুর পরও আসলে আমার কাছে কর্মজীবনের প্রথমদিকের সেই স্মৃতি এখনও অমলিন।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা বেশ সফল হয়েছি। যেমন- ২০১৭ বা '১৯ সালে '৯৮ সালের কাছাকাছি মাত্রার বন্যা হলেও অবকাঠামো উন্নয়ন, পূর্বপ্রস্তুতি আর জনগণের সচেতনতার কারণে আমাদের দেশে বন্যায় প্রাণহানি আর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। একই ধরনের সাফল্য আমরা লক্ষ্য করেছি ঘূর্ণিঝড়পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায়ও।
বাংলাদেশে উপকূলীয় লবণাক্ততা, খরার মতো পরিবেশ বিপর্যয় যেভাবে বাড়ছে, তার থেকে আরও ব্যাপকভাবে বাড়ছে বায়ুদূষণ, নদীদূষণ আর প্লাস্টিক বর্জ্যের মতো আমাদের নিজেদের সৃষ্ট বিপর্যয়। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুসারে শুধু ঢাকা শহর এবং আশপাশ এলাকা থেকে দিনে কম করে হলেও ৬০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী ও খালে ফেলা হচ্ছে। ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জের মতো শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যের মাধ্যমে পানি নিস্কাশনের চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্লাস্টিক বর্জ্য বা প্লাস্টিকদূষণ বাংলাদেশের মতো যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। আমাদের শহরগুলো বসবাস উপযোগী রাখতে হলে সবাইকে প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যার একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
পলিথিন বা প্লাস্টিক নিয়ে মূল সমস্যা হচ্ছে পরিবেশের ওপর প্লাস্টিকের দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব। মূলত প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যা জটিলতর হয় যদি ব্যবহার করা প্লাস্টিক সংগ্রহ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার বা পুনঃপ্রক্রিয়া (রিসাইকেল) করা হয়। তবে আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে প্লাস্টিকের চক্র (সার্কুলার) ইকোনমি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে সার্কুলার ইকোনমি প্রতিষ্ঠার দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
প্লাস্টিক নিয়ে মূল সমস্যা হচ্ছে এটি ভোক্তা ব্যবহার করার পর তার বর্জ্য কীভাবে ফেলে দিচ্ছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দূষণ যা হয় ভোক্তা বা ব্যবহারকারী পর্যায়ে। নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই-তৃতীয়াংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, বিশেষ করে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য ঠিকভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে না। এই প্লাস্টিক বর্জ্য শীতলক্ষ্যা নদীদূষণ আর শহরের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ।
যদিও প্লাস্টিকের ডিসপোজাল পণ্যের ভোক্তা বা ব্যবহারকারী পর্যায়ে হয়ে থাকে, যেখানে আমাদের সে রকম কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এর পরও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনিলিভার থেকে আমরা বিশ্বাস করি যে, প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে আমাদের সবারই কিছু সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের বৈশ্বিক কমিটমেন্ট থেকে সিদ্ধান্ত নিই, উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য হলেও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমরা সরাসরি কাজ করব। ফলাফল হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, ইউএনডিপি আর ইএসডিওর সহযোগিতায় ইউনিলিভার তিন বছরব্যাপী একটি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এটি বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। এ উদ্যোগে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি টেকসই বা সাসটেইনেবল ভ্যালু চেইন প্রতিষ্ঠা করা।
প্লাস্টিক বর্জ্য ঠিকমতো সংগ্রহ বা রিসাইকেল (পুনঃপ্রক্রিয়া) না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে কিছু প্লাস্টিক বর্জ্য বিশেষ করে বিভিন্ন প্যাকেটের রিসাইকেল ভ্যালু বা দাম অনেক কম। কিন্তু ভোক্তা বা ব্যবহারকারী পর্যায়ে যদি প্লাস্টিক বর্জ্য পরিস্কার করে আলাদা (সেগমেন্ট) করা যায়, তাহলে এই বর্জ্যের রিসাইকেল ভ্যালু বৃদ্ধি পায়। নারায়ণগঞ্জে আমরা মূলত এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। এ পর্যায়ে আমরা বর্জ্য সংগ্রহকারীদের সক্ষমতা ও আয় বৃদ্ধি, নগরবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধি- তিন রকম ভিন্ন কালেকশন মডেল নিয়ে ফিল্ড টেস্টিং করছি। আমরা জানি, অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে আমাদের আসলে অনেক কিছু নতুনভাবে জানতে এবং চিন্তা করতে হবে। কিন্তু আমরা আশাবাদী, এই উদ্যোগের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের অন্য শহরগুলোতে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকরী মডেল নিয়ে কাজ করতে সক্ষম হবো।
আমরা এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে তিনটি কালেকশন মডেল নিয়ে কাজ করছি। একই সঙ্গে আমরা ১ হাজার ৩৫৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আর বর্জ্য সংগ্রহকারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছি। ২০২১ সালে আমরা ঢাকায় একটি উদ্ভাবনী স্টার্টআপ নিয়ে অন্য একটি মডেলও ফিল্ড টেস্টিং করছি। আমাদের উদ্যোগের পরবর্তী ধাপে গণমাধ্যমসহ আরও স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করা নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের ৩০ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারব।
আমরা আরও বিশ্বাস করি, সবাই মিলে যদি কিছু ছোট ব্যক্তিগত অভ্যাস বা লাইফস্টাইল পরিবর্তন করি, তাহলে এই পরিবর্তন সমষ্টিগতভাবে পরিবেশ সংরক্ষণে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। আমাদের সন্তানদের জন্য একটা সুন্দর আগামী নিশ্চিত করতে সবাইকে জীবনযাপনে ছোট ছোট পরিবর্তন করে পরিবেশ সুরক্ষার লড়াইয়ে যোগ দিতে হবে। কারণ পৃথিবী একটাই।
জাভেদ আখতার: এমডি ও সিইও, ইউনিলিভার বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন