আগামীকাল চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক মিডল্যান্ডের নবম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। পথচলার দশম বছরে পদার্পণের সময়ে এসে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান-উজ-জামান মিডল্যান্ড ব্যাংক এবং ব্যাংক খাতের নানা বিষয়ে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহীম।

সমকাল: একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে ব্যাংকে টাকা রেখে কম সুদ পাচ্ছেন আমানতকারীরা। ব্যাংক খাতে এর প্রভাব কী?

আহসান-উজ-জামান: মূল্যস্ফীতির তুলনায় আমানতের সুদহার কম হলে স্বাভাবিকভাবে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইবে না। বিকল্প খুঁজবে। তবে এখনও যেহেতু ব্যাংকের বাইরে বড় অর্থ রাখার সুযোগ নেই, ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংকে টাকা রাখছে। কিন্তু এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে নানা 'কানাগলি' তৈরি হবে। বেশি মুনাফার আশায় সেসব কানাগলিতে ঢুকে পড়া মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এটা সামাজিক সমস্যা তৈরি করবে। ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার চিন্তা ভালো। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে এটা কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতিতে চাপিয়ে দিলে অনেকে মানতে বাধ্য হবেন বটে, তবে শেষ পর্যন্ত ফল ভালো নাও হতে পারে।

সমকাল: দেশের অর্থনীতির তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা কি একটু বেশি নয়?

আহসান-উজ-জামান: বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ২৫০-৩০০ বিলিয়ন ডলারের। বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এটা ঠিক, অর্থনীতির তুলনায় সংখ্যাটি একটু বেশি। তবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশে এখনও অপ্রতুল। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, মানসম্পন্ন ব্যাংকিং সেবা প্রসারের আরও সুযোগ আছে।

সমকাল: কী ধরনের ব্যাংকিং সেবার অপ্রতুলতার কথা বলছেন?

আহসান-উজ-জামান: ব্যাংকের শাখায় গিয়ে ব্যাংকিং সেবা নেওয়া এখন সেকেলে ব্যাপার। ডিজিটাল যুগের ব্যাংকিং সেবাও ডিজিটাল হওয়া উচিত। এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত, যেখানে বাসায়, অফিস বা যে কোনো স্থানে থেকে মানুষ ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন। এমন চিন্তা করেই মিডল্যান্ড ব্যাংক সেবা সাজিয়েছে। চাইলে ব্যাংকের শাখায় এসে ব্যাংকিং করতে পারবেন, আবার না এসেও পারবেন। কারও জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলে তিনি চাইলে মিডল্যান্ড ব্যাংকের ওয়েবসাইটের 'ঝটপট' লিংকে গিয়ে নিজেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন।

সমকাল: গ্রামের মানুষ এবং স্বল্প বা অশিক্ষিত মানুষকে ব্যাংকিং সেবায় আনতে আপনার ব্যাংক কী করছে?

আহসান-উজ-জামান: এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আঙুলের ছাপ দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা মিডল্যান্ড ব্যাংকের আছে। গ্রামের মানুষদের এভাবে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার কাজ করে যাচ্ছি।

সমকাল: মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ নানা স্থায়ী সম্পদ কেনায় ব্যাংক অর্থায়ন করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আহসান-উজ-জামান: এ কথা অস্বীকার করা উপায় নেই, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বিশেষত মূলধনী বিনিয়োগে অর্থায়ন করে, তখন ঋণগ্রহীতা যেমন সমস্যায় পড়েন, তেমনি ব্যাংকও পড়ে। কারণ মূলধনী বিনিয়োগ থেকে আয় আসতে সময় লাগে। ঋণ নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে কারখানা হয় না, কিন্তু ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়। এখন যে ব্যবসা শুরুই হলো না, যেখান থেকে ব্যবসায়ী কী করে ঋণ পরিশোধ করবেন? তাছাড়া ব্যবসার মুনাফার টাকা থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি বা ভবনের খরচ পাঁচ-সাত বছরে উঠে আসা অসম্ভব। এদিকে ব্যাংকও এর থেকে বেশি মেয়াদে ঋণ নিতে পারে না। কিন্তু দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এটা বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার কারণে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করছে। আদতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চলতি মূলধনের বাইরে অর্থায়ন করা ঠিক নয়।

সমকাল: এ ধারা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা কি আছে?

আহসান-উজ-জামান: এ নিয়ে নানা ফোরামে নানা কথাবার্তা চালাচালি হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। শেয়ারবাজার কর্তৃপক্ষ দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে এ বাজারকে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছে। কিন্তু নানা কারণে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীরাও সেদিকে খুব বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। এখানে ওই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সমস্যাটিকে শুধু ঠেলে ঠেলে সামনে নিয়ে যাচ্ছি।

সমকাল: আপনার ব্যাংককে এ ঝুঁকি থেকে দূরে রাখতে কী করছেন?

আহসান-উজ-জামান: ঝুঁকি বুঝে এবং সহ্য ক্ষমতার মধ্য থেকে অর্থায়ন প্রস্তাবগুলো মিডল্যান্ড ব্যাংক মূল্যায়ন করে থাকে। আমরা ব্যাংকিংয়ে আগ্রাসী নই। নিজেদের সামর্থ্য বিবেচনা রেখেই ব্যাংকিং করছি। বড় ঝুঁকি এড়িয়ে চলছি। আমানতকারীর আমানত অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চাহিবা মাত্র যাতে টাকা ফেরত দিতে পারি, সে চিন্তা মাথায় রেখে অর্থায়ন করি। যাকে অর্থায়ন করছি, তাঁর সামর্থ্য এবং সহ্য ক্ষমতাও মূল্যায়ন করি। এ ক্ষেত্রে আমরা রক্ষণশীল। আমানতকারীর বিশ্বাস কোনোভাবে নষ্ট করতে চাই না। আমানতের সুরক্ষা সবার আগে।