
প্রতীকী ছবি
৩০ বছর ধরে কৃষিকাজ করেন আতিকুল ইসলাম। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে তাঁর বাড়ি। নিজের ১০ একর জমিতে নানা রকম সবজি চাষ করেন। উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজার কিংবা ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেন। ফলে পান না ন্যায্যমূল্য। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আতিকুল ইসলামের স্বপ্ন ডানা মেলছে। অতীতের বঞ্চনা মুছে কৃষি নিয়ে স্বপ্নের কথা তুলে ধরে এ কৃষক বলেন, পদ্মার ওপর সেতু হবে তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল। এখন উৎপাদিত ফসল সরাসরি নিয়ে যাবেন ঢাকায়। মাঝে থাকবে না কোনো মধ্যস্বত্বভোগী। নষ্ট হবে না পণ্য।
পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে কৃষকরা ব্যাপক পরিবর্তনের আশা দেখছেন। যশোর, খুলনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় উদ্যোক্তারা আগে থেকেই বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন, যাতে সেতু উদ্বোধনের পরপরই এর সুফল পাওয়া যায়। খুলনার আব্দুল হকের আগে পাঁচ একর জমিতে মাছের খামার ছিল। গত মাস চারেক আগে আরও পাঁচ একর জমিতে মাছ চাষ করছেন। পদ্মা সেতু ঘিরে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন জানিয়ে আব্দুল হক বলেন, এখানকার মাছ সাধারণত ঢাকার বাজারে যায় না। অথচ হাজার হাজার টন মাছ হয় এখানে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে মৎস্যজীবীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি খাতে পদ্মা সেতুর বড় প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সমকালকে তিনি বলেন, সেতুর কারণে সব ধরনের কৃষিপণ্য তাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বাজারে যেতে পারবে। ঢাকা ছাড়াও বড় বড় জেলা শহরে পণ্য যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। পদ্মা সেতুর ফলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। কৃষিবান্ধব অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়ে ঘুচবে বেকারত্ব।
বাগদা, গলদা চিংড়ি ছাড়াও মাছ চাষের প্রসিদ্ধ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা। এসব মাছের চাহিদা দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে দেশের বাইরেও রয়েছে। এ ছাড়া এসব অঞ্চল থেকে শসা, করলা, ঝিঙা, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়াসহ নানা রকম তরিতরকারি ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে যায়। মাছ চাষি এবং ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, হিমায়িত পণ্য রপ্তানিকারকরা (বিএফএফএ) নানা কারণ দেখিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা 'কম' উল্লেখ করে স্থানীয় বাজারে দাম কমিয়ে দেন। মাছ চাষিদের আশা, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় চিংড়ি ও সাদা মাছ ঢাকার বাজারে 'সরাসরি' বিক্রি করা যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান বলেন, কৃষকদের গ্রুপ করে তাঁদের উৎপাদিত সবজি সরাসরি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিক্রির উদ্যোগ নিতে কৃষি বিভাগ কাজ করবে।
পদ্মা সেতুর কারণে যেসব জেলা সরাসরি লাভবান হবে এর মধ্যে রয়েছে- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাড়ঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী পদ্মা সেতুর সরাসরি সুফল পাবে। বিশেষ করে খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ এবং বরিশালের ধান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি। যদিও সেখানকার প্রতিটি জেলাতেই ধান ও মাছ চাষ করা হয়। নদী এলাকা বলে প্রাকৃতিক উৎস থেকেও আসে বিপুল পরিমাণ মাছ। যশোরের গদখালীর ফুল ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়। আবার দেশের সবজির বাজারের বড় একটি অংশই আসে যশোর অঞ্চল থেকে।
বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় খাদ্যভাণ্ডার। এ সুযোগ এতদিন পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। পদ্মা সেতুর কারণে সেখানে সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে। পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলে দুধ ও মাংস শিল্প বিকশিত হবে। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষি বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। গত ৫০ বছরে দেশের অন্য অঞ্চলে এর অনেকটাই সফল হয়েছে। কিন্তু পিছিয়ে ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এর প্রধান কারণ হলো, যোগাযোগের অসুবিধা, অর্থাৎ মালপত্র পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা। উৎপাদিত পণ্য বিপণনের দুর্ভোগ, ফসলের মূল্যে অন্যায্যতা, কৃষকের কম লাভজনকতাসহ আরও কিছু সমস্যা ছিল। এসব কারণে ওই অঞ্চলে শস্য নিবিড়তা অপেক্ষাকৃত কম। পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলে কৃষিবিপ্লবের অভিপ্রায় সফল হবে। দ্রুত বেড়ে যাবে শস্যের উৎপাদন। গড়ে উঠবে কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা। তাতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আয় বাড়বে।
মন্তব্য করুন