- অর্থনীতি
- শিল্প-কৃষিতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন
শিল্প-কৃষিতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন

চলমান জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সরকার এক গুচ্ছ সাশ্রয়ী নীতি নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিদ্যুতের চাহিদা আয়ত্তে রাখতে অঞ্চলভেদে দৈনিক এক ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। তবে কোথাও কোথাও লোডশেডিং ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শিল্পকারখানার মালিকরা। রপ্তানি ছাড়াও অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের জোগান দেয় এমন ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানিমুখী শিল্পে উৎপাদন হ্রাসে চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে, বিশেষত রিজার্ভে যার প্রভাব পড়তে পারে।
লোডশেডিংয়ের অভিঘাতে টান পড়েছে সেচ ব্যবস্থাপনায়। ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। সামনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে সার সংকটের। প্রান্তিকে জেনারেটর নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় খামারেই মারা পড়ছে মুরগি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, গত দু'দিনে অনেক এলাকায় লোডশেডিংয়ের শিডিউল মানা হয়নি। ঘোষিত সময়ের আগে-পরে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করেছে। নিজস্ব জেনারেটর না থাকায় ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) মানের বেশিরভাগ কারখানায় পূর্ণ কর্মঘণ্টা উৎপাদন হয়নি। অন্যদিকে মাঝারি ও বড় কারখানাগুলো ডিজেল পুড়িয়ে জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদন ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সমকালকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কথা সবাই জানি। এরপরও অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে হলে শিল্পকারখানা, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশের বেশি আসে সমজাতীয় বিভিন্ন পণ্যসহ তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। এই শিল্পে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব না হলে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেন। একবার স্টক লটের শিকার হলে (অর্ডারের পণ্য ক্রেতারা না নিলে) সংশ্নিষ্ট উদ্যোক্তার পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়। বিদেশি মুদ্রার মজুত কমে আসার প্রবণতার মধ্যে রপ্তানি আয় হারানোর এই ঝুঁকি নেওয়া মোটেও ঠিক হবে না।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, তাঁদের সদস্য কারখানাগুলো এলোমেলো লোডশেডিংয়ে উৎপাদন ব্যাহতের তথ্য দিচ্ছে। গত মঙ্গলবার থেকে অনেক কারখানা দুই ঘণ্টার বেশি জেনারেটর চালিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। ব্র্যান্ড ক্রেতারা পোশাকের দরে এক সেন্টকেও খুব গুরুত্ব দেন। কম পেলে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না তাঁরা। লোডশেডিংয়ের শিডিউল মানা গেলে স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার আগে-পরে অথবা ছুটির দিনে কাজ করিয়ে ক্ষতি পোষানো সম্ভব হতো।
বাণিজ্য বিশ্নেষকরা বলছেন, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন দেশ রেকর্ডকালের মূল্যস্ম্ফীতির মুখোমুখি হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে রপ্তানি বাজারে চাহিদাও পড়তি। ওইসব দেশের ভোক্তাদের খাদ্যের পেছনেই আয়ের বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে পোশাকের মতো পণ্যের চাহিদা কমে আসা স্বাভাবিক। এর মধ্যে উৎপাদন ব্যাহত হলে পোশাক খাতকে বড় বিপদে পড়তে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি খাত চাপে পড়বে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। সময়মতো পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে না পারলে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাবে। ইতোমধ্যে রপ্তানি আদেশ কমতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি থেকে সহসা বের হওয়া সম্ভব হয়তো হবে না।
বিটিএমএ সূত্র জানায়, বস্ত্রকলে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের কারণে বিদ্যুতের চেয়ে গ্যাসের অভার বড় সমস্যা। দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ থাকছে না। যেখানে ১৫ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি) থাকার কথা, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে এক-দুই পিএসআই। ডায়িং ও প্রিন্টিংয়ের মান খারাপ হচ্ছে। রাতে গ্যাসের চাপ বাড়লে কাজ করার চেষ্টা করছে অনেকে।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল বারেক খান জানান, তাঁদের সব পাটকলে নিজস্ব জেনারেটর নেই। বিদ্যুৎ গেলে শ্রমিকরা বসে থাকছেন। এখন তাঁরা এই সংকটে কী ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তা নিরূপণের চেষ্টা করছেন।
সেচ সংকটে চাষাবাদ ব্যাহত :রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষক আবদুল আজিজ পাঁচ একর জমিতে রোপা আমনের জন্য বীজতলা করেছেন। তাপদাহে পানি দিতে না পারায় মরতে বসেছে বীজতলা। শ্রাবণে খরা ও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে দিশেহারা তিনি।
এই অবস্থা পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে। সেচকাজে এখানের কৃষকের একমাত্র ভরসা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডি) গভীর নলকূপ। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে এখন পানি মিলছে না। গাইবান্ধা সদরের বল্লমঝাড় ইউনিয়নের তালক মন্দুয়ার গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম বলেন, 'ঝড়ি হয় না, কারেন্টের অভাবে মেশিন দিয়্যা পানিও নিব্যার পাচ্চিনে। এব্যারক্যা যে ক্যামন করি চলমো তাই নয়্যা চিনতাত আচি।'
দেশে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৪ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ৫৯ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে রোপা আমন চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেনজীর আলম বলেন, জুলাই-আগস্ট আমন ধান রোপণের মৌসুম। এবার রোপা আমনের লক্ষ্য ৫৯ লাখ ৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে। জুলাই শেষ হতে চললেও মাত্র ৩ লাখ ৮৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে রোপণ হয়েছে।
লোডশেডিং দীর্ঘায়িত হলে চলতি মৌসুমে সারাদেশেই আমন ক্ষেত হুমকির মুখে পড়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহতের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, কৃষিকে লোডশেডিংয়ের আওতামুক্ত রাখতে হবে। ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রে খরচ বেশি হওয়ায় কৃষক ও মালিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র অপসারণ করে তা দ্রুত পরিবেশবান্ধব সৌরশক্তিচালিত সেচযন্ত্রে রূপান্তর প্রয়োজন।
বিএডিসির খামার প্রযুক্তি, সেচ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক শেখ মেহদী মোহাম্মদ বলেন, প্রযুক্তি বিদেশি হওয়ায় সোলার প্যানেলের ব্যয় অনেক বেশি। স্বল্পমূল্যে প্যানেল দেওয়ার বিষয়ে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ভাবতে হবে। সেচে সৌরশক্তির পাশাপাশি খালবিল কাজে লাগাতে হবে।
সার সংকটের শঙ্কা: সরকারি সার কারখানায় অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেও ইউরিয়ার প্রত্যাশিত উৎপাদন হচ্ছে না। গ্যাসের দাম বাড়ায় চলতি মাসে বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রি (সিইউএফএল)। এতে কৃষিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা। খোদ কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, যমুনা ও চট্টগ্রাম সার কারখানা দুটিতে গ্যাস সংকটের কারণে সার উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। এতে ইউরিয়া সার নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়ে গেছে।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে ইউরিয়া সার আমদানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে এবং সারে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে। এ ছাড়া গ্যাস সংকটের কারণে সার কারখানা বন্ধ হলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
বিপাকে পোলট্রি খামারিরা: লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন পোলট্রি ও হ্যাচারি খামারিরা। পল্লী বিদ্যুতের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে মারা যাচ্ছে মুরগি। বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) সাধারণ সম্পাদক মোহসিন আলী খন্দকার বলেন, এবার তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনিতেই স্ট্রোকে মুরগি মারা যাচ্ছে। প্রান্তিক গরিব খামারিরা জেনারেটর পাবে কোথায়? এর ওপর এখন লোডশেডিং মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করতে আমরা নির্দেশনা দিচ্ছি। তবে বিদ্যুৎনির্ভর পোলট্রি খামারিরা যাতে বিপদে না পড়েন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন