ব্যাংকের পাশাপাশি নগদ ডলারেরও চরম সংকট তৈরি হয়েছে। খোলাবাজারে গতকাল ১১৯ টাকা পর্যন্ত দরে ডলার বিক্রি হয়েছে। আগের কর্মদিবসে দাম ছিল ১১৫ টাকা। ব্যাংক ও মানিচেঞ্জারে প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। নগদ ডলারের পাশাপাশি আমদানি ঋণপত্র খোলার ডলারেও সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এলসি খুলতে ১১২ টাকা পর্যন্ত দর উঠেছে। এ রকম দরের পরও বড় এলসি ফেরত দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। অবশ্য বাজার সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রি অব্যাহত আছে। কারসাজি ঠেকাতে অব্যাহত রাখা হয়েছে পরিদর্শন কার্যক্রমও। তবে কোনো কিছুতেই বাগে আসছে না বাজার।

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এমনিতেই সংকট রয়েছে। এর মধ্যে ডলারের দর আরও বাড়ার আশঙ্কায় অনেকে নগদ ডলারে বিনিয়োগ করে রাখছেন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু সিদ্ধান্তের কারণে আন্তঃব্যাংক ডলার বিক্রি একরকম বন্ধ আছে। দর বৃদ্ধি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মৌখিকভাবে ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করবে আন্তঃব্যাংকে তার কাছাকাছি দরে বেচাকেনা করতে হবে। এখন ৯৫ টাকা দরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বেচলেও কোনো ব্যাংক এ রকম দামে পাচ্ছে না। ফলে আন্তঃব্যাংকে বিক্রি করছে না।

এ ছাড়া এক ব্যাংকের রপ্তানি বিল আরেক ব্যাংকের কাছে বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ডলার কিনেও চাহিদা মেটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে ডলার সংকটে থাকা ব্যাংকের চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায় এখন বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস। এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো ডলারের দর হাঁকছে ১১০ থেকে ১১২ টাকা। এ কারণে ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরছে না। এর মধ্যে ৬ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনার পর আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

জানা গেছে, বাজার ঠিক রাখতে বুধবার কয়েকটি ব্যাংকের কাছে আরও ১১ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবার বিক্রি করা হয় ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের দেড় মাসের কম সময়ে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি ৮০ লাখে। গত অর্থবছর বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে আরও ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এভাবে বিক্রির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গতকাল ৩৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ উঠেছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।

চলতি বছরের শুরুর দিকেও আমদানিতে ৮৭ টাকার মতো দর ছিল ডলারের। এখন ১১২ টাকা পর্যন্ত দরে ডলার কিনে এলসির দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। চলতি বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। কারও কারও ধারণা অর্থ পাচার বৃদ্ধির ফলে হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ডলার বাজার ঠিক হচ্ছে না।

বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে ডলারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত তথ্য আড়াল করে কৃত্রিমভাবে বাজার ভালো দেখানোর চেষ্টা করে। পরিস্থিতি খুব খারাপ হওয়ার পর গত এপ্রিল থেকে এলসি মার্জিনহার বাড়ানোসহ বিভিন্ন উপায়ে আমদানি কমানোর চেষ্টা করা হয়। পরে একের পর এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এসব সিদ্ধান্তের ফলে আন্তঃব্যাংক লেনদেন একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। এক ব্যাংকের রপ্তানি বিল আরেক ব্যাংক কিনতে পারছে না। এর মধ্যে রিজার্ভ ব্যাপক কমে গেছে। সব মিলিয়ে সামনে কী অপেক্ষা করছে, এ নিয়ে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো যাচ্ছে না। বাজার ঠিক করতে দ্রুত আন্তঃব্যাংক লেনদেন ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেওয়া এবং রপ্তানি বিল যে কোনো ব্যাংকের কাছে ভাঙানোর সুযোগ দেওয়া দরকার। তাতে আন্তঃব্যাংক লেনদেন কার্যকর হবে। বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের ওপর নির্ভরতা কমে বাজার ঠিক হয়ে আসবে।

খোলাবাজারে নগদ ডলার কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত একজন সমকালকে জানান, ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। খুব সামান্য যে ডলার পাওয়া গেছে তার দর ছিল অনেক চড়া। বুধবার দিনের শুরুতে ১১৭ টাকায় ডলার বেচাকেনা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তা ১১৯ টাকা পর্যন্ত দর ওঠে। এ রকম দরেও ডলার কিনতে অনেকে রাজি ছিলেন। তবে তিনি সরবরাহ করতে পারেননি।

সংশ্নিষ্টরা জানান, গত সোমবার খোলাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ১১৫ টাকায়। এর আগে গত ২৬ আগস্ট ডলার ১১২ টাকায় উঠেছিল। প্রথমবারের মতো নগদ ডলারের দর ১০০ টাকার ঘর অতিক্রম করে গত ১৭ মে। পরবর্তীতে সামান্য কমে ৯৮ থেকে ৯৯ টাকায় ডলার বিক্রি হচ্ছিল। পরে ১৭ জুলাই আবার বেড়ে ১০২ টাকায় ওঠে। এর মধ্যে দেশের বাজারে তেলের দর গড়ে ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধির পর অনেকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে মনে করছেন, দেশে ডলারের বড় সংকটের কারণে আগামীতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দরও বাড়তে পারে। ফলে ডলার কিনে রাখলে অনেক লাভ পাওয়া যাবে। এসব কারণে বিভিন্ন অভিযানের মধ্যে নিজের কাছে ডলার ধরে রেখেছেন অনেকে।
একটি মানিচেঞ্জারের মালিক জানান, ব্যাংকের পাশাপাশি মানিচেঞ্জারে বিভিন্ন পক্ষের অভিযান চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিদিনই পরিদর্শন করছে। এতে আতঙ্কের কারণে নগদ ডলার কিনে রাখা ব্যক্তিরা চাইলেও আর বিক্রি করতে সাহস পাচ্ছেন না। ব্যাংকার ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করার নির্দেশনার পরও নগদ ডলারে সংকট তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই ডলারের দর বাড়তি। এর মধ্যে অতিরিক্তি মুনাফার সুযোগ নিয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক। এখন ৩০ লাখ ডলার বা এর বেশি মূল্যের এলসির তথ্য নিয়মিতভাবে যাচাই করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অস্বাভাবিক মুনাফা করায় গত সোমবার বেসরকারি ব্র্যাক সাউথইস্ট, দি সিটি, ডাচ্‌-বাংলা ও প্রাইম এবং বিদেশি মালিকানার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করতে বলা হয়। এসব ব্যাংকের আরও উচ্চ পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কার্যক্রম খতিয়ে দেখছে। অবশ্য ডলার বেচাকেনায় ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ স্প্রেড নিতে পারবে সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। তবে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলো নিজেরা বসে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সর্বোচ্চ স্প্রেড হবে ১ শতাংশীয় পয়েন্ট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ব্যাংকের চাহিদা বিবেচনায় বুধবারও বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করেছে। পাশাপাশি বাজার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি অব্যাহত আছে।