দেশের ই-কমার্স খাতের বিকাশে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন আম্বারীন রেজা। পরিশ্রম, উদ্ভাবনী আইডিয়া ও দূরদর্শিতার জন্য পেয়েছেন আকাশচুম্বী সাফল্য। আম্বারীনের নেতৃত্ব ফুডপান্ডাকে দেশের অন্যতম শীর্ষ ফুড ও গ্রোসারি ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করেছে। ফুডপান্ডাই বাংলাদেশের একমাত্র কুইক-কমার্স সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, ফুডপান্ডা দেশের একমাত্র অনলাইন খাবার ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান; যার সেবা দেশজুড়ে বিস্তৃত। এই প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের পাশাপাশি শিক্ষা-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান শিখো, ফসলসহ বেশ কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন আম্বারীন রেজা।
চাকরি খোঁজার দিন
২০১৩ সালের এপ্রিলে হঠাৎ আম্বারীনের বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর দুই ভাইবোন তখনও বেশ ছোট। পরিবারের বড় সন্তান আম্বারীন; কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব। হাল ধরতে হবে পরিবারের। অস্ট্রেলিয়ায় স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়ে ততদিনে চাকরিও জোগাড় করেছেন। কিন্তু পরিবারের হাল ধরতে অস্ট্রেলিয়ার পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে চাকরি খুঁজতে শুরু করেন আম্বারীন। 'রকেট ইন্টারনেট' নামের এক বিদেশি প্রতিষ্ঠানে ডাক পেয়ে তাদের হয়ে দেশে ই-কমার্স ব্যবসা চালু করেন। আম্বারীনের হাত ধরে ২০১৩ সালের নভেম্বরে 'লামুডি'র কার্যক্রম শুরু হয় বাংলাদেশে। লামুডি নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি 'কারমুডি' নামে গাড়ির বিপণনের একটি আলাদা সাইট নিয়েও কাজ করেন আম্বারীন। লামুডি-কারমুডির পরপরই চালু হয় 'কেইমু'। তিনটি সাইটেই সফল আম্বারীন। তবু কেন যেন তার মনে একটা অতৃপ্তি কাজ করে। সেই অতৃপ্তি আর নতুন কিছু করার প্রত্যাশায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
ফুডপান্ডার প্রস্তাব
চাকরি ছেড়ে দিলেও রকেট ইন্টারনেট ছাড়তে চায় না আম্বারীনকে। কেননা, এমন নির্ভরযোগ্য ও সফল তরুণ কোথায় পাবেন তারা! ফলে রকেট ইন্টারনেট তাঁকে প্রস্তাব দেয় দেশে ফুডপান্ডার কার্যক্রম শুরু করার। তবে এবারের প্রস্তাবটি ছিল পুরোই ভিন্ন। প্রতিষ্ঠানটি বলল, কেবল চাকরি নয়, সহ-উদ্যোক্তা হিসেবে ফুডপান্ডার সঙ্গে যুক্ত হও। মানে কোম্পানিতে থাকবে আম্বারীনের মালিকানাও। এমন কিছু করার চিন্তা থেকেই চাকরি ছেড়েছেন আম্বারীন। ফলে সুযোগটা লুফে নিয়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্ত হন ফুডপান্ডার সঙ্গে।
শুরুর কথা
রাজধানী ঢাকায় স্বল্প পরিসরে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে ফুডপান্ডা। এরপর আস্তে আস্তে সেবার বিস্তৃতি বাড়াতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বাড়তে বাড়তে ২০২০ সালে দেশের সব জেলায় অনলাইন খাবার ডেলিভারি সেবা পৌঁছে দেয় ফুডপান্ডা। একই বছরে কাজ শুরু করে গ্রোসারি নিয়েও। লোকাল দোকান, সুপারশপগুলোকে নিয়ে আসে ফুডপান্ডার শপস সেবার আওতায়। এতে ক্রেতা খুব অল্প সময়েই প্রয়োজনীয় পণ্য অর্ডার করতে পারেন। শপসের পর ফুডপান্ডা চালু করে নিজস্ব গ্রোসারি ডার্ক স্টোর 'পান্ডামার্ট'। লক্ষ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কেনাকাটা সহজ করা এবং মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে তা গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। পান্ডামার্ট দেশের বড় শহরগুলোতে নিজেদের সেবার পরিধি বাড়িয়েছে।
নতুন ফিচার ও যত সুযোগ-সুবিধা
গ্রাহকের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা দিতে নতুন সেবা ও ফিচার চালু করছে ফুডপান্ডা। পান্ডাগো ও পান্ডাপ্রো তেমনি দুটি নতুন ফিচার। এ ছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং এর কর্মীদের খাবার অর্ডার সহজ ও সুবিধাজনক করার লক্ষ্যে চালু রয়েছে ফুডপান্ডা ফর বিজনেস। আর পান্ডাপ্রো সেবার আওতায় প্ল্যাটফর্মটির গ্রাহকরা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে চার্জ দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। প্রতি মাসে ১০টি ফুড ও গ্রোসারি অর্ডারে ফ্রি ডেলিভারি সুবিধা, পান্ডামার্টে বিভিন্ন ডিসকাউন্ট, ভাউচারসহ নিয়মিত আকর্ষণীয় ডিলস ও অফার উপভোগ করতে পারবেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য ডাইন-ইন সুবিধা চালু করেছে ফুডপান্ডা। ডাইন-ইন সুবিধাটি প্রতিষ্ঠানটির নতুন সাবস্ট্ক্রিপশন সেবা পান্ডাপ্রোর একটি বিশেষ ফিচার। এ ফিচারের মাধ্যমে পাঁচশর বেশি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় পান্ডাপ্রো গ্রাহকরা ডাইন-ইনে ২৫ শতাংশ ছাড় পাবেন।
কর্মসংস্থানে ফুডপান্ডা
দেশে প্রযুক্তি খাতে শীর্ষস্থানীয় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ফুডপান্ডা। এখন পর্যন্ত ফুডপান্ডা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সারাদেশে কয়েক হাজার রাইডার কাজ করে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। নিজেদের ব্যবসার ডিজিটাল রূপান্তর করেছেন ৩৫ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা। তাদের ব্যবসার অনলাইন রূপান্তর করে ডিজিটাল ইকোনমিতে যুক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ফুডপান্ডা। নারীরা রাইডার কিংবা পিকার হিসেবে কাজ করতে পারছেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্যে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীকে এ খাতে যুক্ত করেছে ফুডপান্ডা। হোমশেফ উদ্যোগের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজ হয়েছে। কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ঘরে তৈরি খাবার ফুডপান্ডা প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করে উপার্জনের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হচ্ছেন অনেকেই।
ফুডপান্ডার খাবার পায় অবহেলিতরাও
খাবারের অপচয় রোধে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে ফুডপান্ডা বাংলাদেশ। এই যৌথ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা ফুডপান্ডা প্ল্যাটফর্মে বাতিল হওয়া অর্ডারের খাবার নির্দিষ্ট রাইডার হাব থেকে সংগ্রহ করে সুবিধাবঞ্চিতদের মাঝে বিতরণ করে। এমন মানবিক উদ্যোগ সম্পর্কে আম্বারীন রেজা বলেন, 'আসলে খাবারের এই অপচয় রোধে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে বলে আমরা খুবই আনন্দিত। এই যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা শুধু খাবারের অপচয় কমাতেই সক্ষম হব না, পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে আমরা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের খাবার দিয়ে সহায়তা করে টেকসই ভবিষ্যৎ অর্জনে সক্ষম হব।'
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে আম্বারীন রেজা বলেন, 'বিশ্বজুড়েই অনলাইন ফুড ডেলিভারি ইন্ডাস্ট্রি একটি বিকাশমান খাত। বেশ কয়েক বছরে এ খাতের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশেও এ খাতের প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। ফুডপান্ডা দেশের ৬৪ জেলায় ফুড ও গ্রোসারি ডেলিভারি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া নিজস্ব গ্রোসারি ডেলিভারি সেবার ডার্কস্টোর পান্ডামার্ট দেশের সব বড় শহরে চালু রয়েছে। আগামীতে আমাদের এই কার্যক্রম বিস্তৃত করার পাশাপাশি সেবার মান আরও বাড়াতে কাজ করব।'