নারায়ণগঞ্জের এমবি নিটে সপ্তাহে এখন চার দিন ছুটি। এর মধ্যেও দিনের পূর্ণ কর্মঘণ্টা কাজ হয় না কোনো কোনো দিন। চার ঘণ্টা ক্যাপাসিটির জেনারেটর বেশিক্ষণ চালিয়ে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকির সঙ্গে উচ্চমূল্যের ডিজেল পুড়িয়ে উৎপাদনে শুধু লোকসানই বাড়ে। অর্থাৎ যত বেশি উৎপাদন, তত বেশি লোকসান। ডিজেল বাবদ বাড়তি ব্যয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশ।

অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে কাপড়সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জোগানও ঠিকমতো মিলছে না। শ্রমিকদের বেকার বসিয়ে রাখার চেয়ে ছুটি দেওয়াই সুবিধাজনক মনে করছেন কারখানাটির মালিক মোহাম্মদ হাতেম। লোকসান কমাতে এরই মধ্যে ১০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই করার কথাও জানিয়েছেন তিনি। অথচ কারখানাটিতে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের রপ্তানি আদেশ রয়েছে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত। পোশাকের নিট ক্যাটাগরির পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ হাতেম। বিকেএমইএর প্রায় সব কারখানা একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে সমকালকে জানান তিনি।

গত ৫ আগস্ট মধ্য রাতে অন্যান্য জ্বালানির সঙ্গে শিল্প-কারখানায় ব্যবহূত ডিজেলের দর এক লাফে সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়। শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং এবং জ্বালানি তেলের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। মোট উৎপাদনও কমেছে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক কারণে রপ্তানি আদেশ এমনিতেই কিছুটা কম। গত ফেব্রুয়ারি থেকেই বিশ্ববাজারে এই অবস্থা চলছে। তবে রপ্তানি খুব একটা কমেনি। জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধির প্রভাব পড়ার আগেও রপ্তানি বৃদ্ধির হার ছিল ৩৬ শতাংশ। জ্বালানির দর বৃদ্ধির কারণেই হঠাৎ রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় নেমে আসে।

তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, লোকসান কমাতে অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। বাড়তি দর না পাওয়ায় ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি করছেন না কেউ কেউ। প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ম্ফীতির কারণে ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদাও কিছুটা কম। অনেক ব্র্যান্ডের স্টকে পণ্যের স্তূপ জমেছে। আবার তুলাসহ কাঁচামালের দর কিছুটা পড়তির দিকে। এ কারণে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারাও রপ্তানি আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরে এগুচ্ছে। এতে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা কমে আসত; কিন্তু নেতিবাচক ধারায় নেমে যাওয়ার কারণ ছিল না।

জানা গেছে, ডিজেলের মূল্য সমন্বয় করার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ। সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, পোশাক কারখানাগুলোতে চরম বিদ্যুৎ সংকট চলছে। সপ্তাহিক ছুটি দু'দিন করা হয়েছে। দিনের কর্মঘণ্টা এক ঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়েছে। লোডশেডিং চলাকালে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে উচ্চমূল্যের ডিজেলে জেনারেটর ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। গত বছরের ৮০ টাকা লিটারে কেনা ডিজেল এখন ১০৯ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ডিজেলের দর সমন্বয় করে পুনর্নির্ধারণ করা হলে পোশাক শিল্পসহ সংশ্নিস্ট সবাই উপকৃত হবেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন অব্যাহত রাখার স্বার্থে ডিজেলের দর সমন্বয় এবং সরবরাহ ঠিক রাখতে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়।

মোহাম্মদ হাতেম জানান, বিশ্ববাজারে চাহিদা কম, তা ঠিক। তবে যতটুকু চাহিদা, তা তো মেটাতে হবে। ক্রেতারা আবার রপ্তানি আদেশ বাড়াতে চায়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সুইডেনভিত্তিক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান এইচ অ্যান্ড এমের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন ঢাকা সফরে রয়েছেন। এ দেশ থেকে আরও পোশাক নিতে চায় এইচ অ্যান্ড এম। কারণ এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ছাড়া ভালো বিকল্প নেই ক্রেতাদের সামনে। তবে জ্বালানির উচ্চদর এবং সংকটে উল্টো রপ্তানি কমছে। ডিজেলের দর কমাতে বিকেএমইএ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেবে বলেও জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান সমকালকে বলেন, লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটে তাঁর কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম হচ্ছে। ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাসের অভাব বড় সমস্যা। ডাইং এবং ফিনিশিং কারখানায়ও গ্যাসের প্রয়োজন। দিনে গ্যাসের চাপ থাকছে না। ডাইং ও প্রিন্টিংয়ের মান খারাপ হচ্ছে। এতে পরিত্যক্ত পণ্যের পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ নানামুখী লোকসান বাড়ছেই।