আমদানি দায় কমাতে নানা উদ্যোগের পরও কাটছে না ডলার সংকট। এর মধ্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমছে। এ সময়ে সরকারি ঋণপত্রের দেনা মেটাতে কোনো ব্যাংক যেন ব্যর্থ না হয় সে জন্য নিয়মিতভাবে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল কয়েকটি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরে বিক্রি ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে চলতি ২০২২ পঞ্জিকা বছরের এ পর্যন্ত বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

নিয়মিতভাবে ডলার বিক্রির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। গতকাল রিজার্ভ নেমেছে ৩৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) দেনা পরিশোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভ আরও কমবে। গত বছরের এ সময়ে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল গত বছরের আগস্টে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। শুধু সরকারি এলসির দায় মেটাতে এখন ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ করে সার, জ্বালানি এবং জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানির বিপরীতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোকে এ ডলার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা এবং রপ্তানি বিল নগদায়নে ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা দর দিচ্ছে। ডলার কেনার গড় দরের ভিত্তিতে আমদানি দায় নিষ্পত্তি করছে। মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার সর্বনিম্ন ১০১ টাকা ৩৮ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি হয়।

গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকের এমডিদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন এবিবি এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা বৈঠক করে। তারা বর্তমান সংকট মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোকেও ডলার সরবরাহের অনুরোধ জানায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সায় দেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব উৎস থেকেই ডলার সংগ্রহ করে এলসি খুলতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারি জরুরি আমদানি ছাড়া ডলার সহায়তার সুযোগ নেই। ডলারের সরবরাহ বাড়াতে রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে দেশের বাইরে নিজস্ব এক্সেঞ্জ হাউস খোলা, রেমিট্যান্স পাঠাতে সার্ভিস চার্জ না নেওয়াসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকায় এলসির দেনা পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন যে পর্যায়ে নেমেছে তাতে ঢালাওভাবে ডলার বিক্রি করলে ঝুঁকিতে পড়তে হবে। যে কারণে এখন আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমদানিতে তদারকি জোরদার, শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন নির্ধারণসহ বিভিন্ন উপায়ে এলসি কমানো হয়েছে। এরপরও জুলাই-আগস্ট সময়ে প্রায় ১৭ শতাংশ আমদানি বেড়ে এক হাজার ২৬৯ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।

আমদানি দায় না কমলেও রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমছে। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কমার পর অক্টোবরে কমেছে ৮ শতাংশ। আবার সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কমার পর অক্টোবরে কমেছে ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ। অথচ দেশের বাইরে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে শ্রমিক গেছে ৮ লাখ ৭৫ হাজার। ২০২১ সালে পুরো বছরে এ সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার। শ্রমিক অভিবাসন বাড়লেও অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা দর দিচ্ছে। হুন্ডি কারবারিরা যেখানে দিচ্ছে ১১০ থেকে ১১২ টাকা পর্যন্ত। আবার কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই প্রবাসীর কর্মস্থল বা বাসায় গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে হুন্ডি কারবারিরা। ব্যাংকের তুলনায় বেশি দর এবং ঝামেলামুক্তভাবে ডলার পাওয়ায় বুঝে না বুঝে প্রবাসী অনেকে অবৈধ পন্থা বেছে নিচ্ছেন। ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স কমছে।