১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান ছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। এমন স্পষ্ট করে পৃথিবীর খুব কম সংবিধানেই বলা হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের সময় ১৯৭২ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে যা কিছু স্বীকৃত ছিল এবং জুডিসপ্রুডেন্সে (আইনশাস্ত্রে) যা কিছু সর্বজনীন হিসেবে গৃহীত হয়েছিল, তার সবই আমাদের সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের সংবিধানে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক জাতিসংঘের দলিলও যুক্ত হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই দুটি বিষয়ই রাষ্ট্র বাধ্যতামূলক হিসেবে গ্রহণ করতে পারত।

কিন্তু ১৯৭২ সালে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন তাঁরা হয়তো চিন্তা করেছেন এই সীমিত সম্পদের দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার কতটুকু রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়! রাষ্ট্র তা কতটুকু সুরক্ষিত করতে পারবে বা জনগণকে দিতে পারবে। এসব চিন্তা থেকেই হয়তো নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো একই মর্যাদা পায়নি।

বরঞ্চ সংবিধানে এগুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলা হয়েছে। তবে মূলনীতি বলা হলেও সে একই জায়গায় সংবিধানে বলা হয়েছে, এই নীতিগুলোর কোনো স্খলন ঘটলে বা লঙ্ঘিত হলে একজন নাগরিক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন না। তবে এ বাধাটা কিন্তু রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা এই দুটি অধিকারের কোনোটিতে একটু বিচ্যুতি ঘটলে একজন আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। আদালতও তাকে প্রতিকার দিতে বাধ্য থাকেন, সংবিধানে সেটিই বলা হয়েছে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সংবিধান প্রবর্তনের ৫০ বছর হলেও এখনও এই তফাতগুলো রয়ে গেছে। আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতির দুই-একটিও কিন্তু এখনও পর্যন্ত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারিনি। নেপালের মতো দেশেও এগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এ নিয়ে কোনো বিচ্যুতির সুযোগ আমাদের সংবিধান দেয়নি। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন আছে, এই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু। এখানে বলা যায়, কোনো স্বাধীনতাই অসীম নয়। এখানে চিন্তার স্বাধীনতা অবাধ। এতে বিধিনিষেধ আরোপ হয়নি। কিন্তু এই চিন্তা যখন প্রকাশ করা হয় এবং সেটি কতটুকু বিস্তৃত হবে সেটি আলোচনার বিষয়। কোনো রাষ্ট্র এটিকে অসীম বা অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশের সুযোগ দেয়নি। কারণ কোনো মত যদি অন্যকে আহত করে এবং সেটি যদি অন্যায়ভাবে হয় তাহলে কিন্তু সেটি প্রকাশের সুযোগ নেই। এতে বিশৃঙ্খল অবস্থা বা অরাজকতা সৃষ্টি হলে তা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। মতপ্রকাশের বিষয়টি সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা, সহনশীলতার সীমাসহ নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। তাই কিছু হলেই বলা যাবে না মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাহত বা লঙ্ঘিত হয়েছে।

সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। তবে আইনটির প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফলে এটি পর্যালোচনা করে কোথায় কোথায় ত্রুটি রয়েছে তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার সৎপ্রচেষ্টা অবশ্যই রাষ্ট্রের থাকতে হবে এবং তা প্রদর্শন করতে হবে।

লেখক: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান