এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের গ্রাহককে পরিশোধ করার সুযোগ মিলছে বেশ আগে থেকেই। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে ব্যাংক থেকে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা এমএফএস থেকে ব্যাংকে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা চালুও হয়েছে। তবে এখন একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিকাশ, রকেট, এম ক্যাশের মতো এক এমএফএস থেকে আরেক এমএফএস বা ব্যাংকে টাকা পাঠানো যাবে নিমেষেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় চালু হওয়া 'বিনিময়' নামের ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট খুলে সহজে ও দ্রুত লেনদেন করা যাবে। গত রোববার ১২টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও এরই মধ্যে এতে যুক্ত হয়েছে ১৫টি। অপেক্ষায় রয়েছে আরও ১৪টি প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের দিক থেকেও 'বিনিময়' নিয়ে যেন আগ্রহের কমতি নেই। ফলে ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরিতে নতুন এ প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।

বিনিময় প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে আপনাকে আলাদা কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে না। আপনার যে ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠান এ প্ল্যাটফর্মে যুক্ত কিনা জানতে হবে। এর পর ব্যাংক বা এমএফএসের অ্যাপে 'বিনিময়' আইকন থেকে একটি ভার্চুয়াল আইডি খুলতে হবে। সেখান থেকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সহজে ও দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করা যাবে। আপনি যাকে টাকা পাঠাতে চান কেবল তার ভার্চুয়াল আইডিতেই টাকা পাঠানো যাবে। নাম, ব্যাংক বা অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেওয়ারও প্রয়োজন পড়বে না। আপনার অ্যাপের বিনিময় আইকনে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাটনে চাপতে হবে। এর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টে দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, রেজিস্টার্ড মোবাইল নম্বর, ই-মেইল ও টিআইএন নম্বর নিয়ে নেবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার মতো অনেক ক্ষেত্রে বাসার ঠিকানা চাইতে পারে। আপনি যে নামেই ভার্চুয়াল আইডি খুলুন, শেষ অংশে যুক্ত হবে @binimoy.gov.bd। ধরুন আপনি সামিন নামে একটি আইডি খুলতে চান। এ ক্ষেত্রে আপনার আইডি হবে samin@binimoy.gov.bd.

নিবন্ধনের পর আপনি কাউকে পরিশোধ করতে চাইলে কেবল তার বিনিময় আইডি লাগবে। আবার আপনাকে কেউ টাকা দিতে চাইলে ভার্চুয়াল আইডিতে পাঠালেও আপনার হিসাবে যুক্ত হবে। টাকা পাঠানোর জন্য 'ডিরেক্ট পে' অপশনে গিয়ে যাকে টাকা পাঠাবেন তার বিনিময় আইডি দিতে হবে। এর পর টাকার অঙ্ক লিখতে হবে। পরের ধাপে বিনিময়ের 'পিন' এবং যে অ্যাপ থেকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন তার 'পিন' দিয়ে লেনদেন সম্পন্ন হবে। কোনো কারণে পরিশোধ না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার টাকা জমা হবে আপনার হিসাবে। একই আইডি দিয়ে একাধিক ব্যাংক বা এমএফএসে টাকা গ্রহণ করা যাবে কিনা সে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের। একই আইডি থেকে একাধিক অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনে কোনো বাধা নেই। তবে আপনার ভার্চুয়াল আইডি যখন যে হিসাবের সঙ্গে যুক্ত করে রাখবেন, সেখানেই টাকা জমা হবে বা সেখান থেকে পাঠাতে পারবেন। আপনি চাইলে নিজের প্রয়োজন ও সুবিধামতো ভার্চুয়াল আইডি নতুন হিসাবের সঙ্গে যুক্ত করতে পারবেন।

ব্যাংক, এমএফএস, পিএসপি ও পিএসওর মধ্যে লেনদেনের এ প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে গত ১৩ অক্টোবর। বিনিময় প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করে দিয়েছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। সরকারি একটি প্রকল্পের আওতায় যা বাস্তবায়ন হয়েছে।

দেশে বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ৬১টি। সারাদেশে এসব ব্যাংক প্রায় ১১ হাজার শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম চালাচ্ছে। নগদসহ ১৩টি রয়েছে এমএফএস প্রতিষ্ঠান। পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটর ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার রয়েছে ১৩টি। সব প্রতিষ্ঠান বিনিময় ব্যবস্থায় যুক্ত হলে যে কোনো বিল পরিশোধ, টিকিট এবং অন্যকে পরিশোধ সবই করা যাবে। যাকে পরিশোধ করবেন তার ব্যাংক বা এমএফএস কোথায় অ্যাকাউন্ট আছে- এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
কেননা বিনিময় ব্যবস্থায় লেনদেন করতে অন্যের অ্যাকাউন্ট নাম, নাম্বার বা ব্যাংকের নাম কিছুই জানতে হবে না। কেবল ভার্চুয়াল আইডি জানলেই আপনি টাকা পাঠাতে পারবেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের পরিচালক মো. মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, বিনিময় ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে একজন আরেকজনকে পরিশোধ ছাড়াও বিভিন্ন বিল কালেকশনের সহজ মাধ্যম হবে। এক অ্যাকাউন্টে যেহেতু সব মাধ্যম থেকে পরিশোধ করা যাবে, ফলে মেট্রোরেল, বিভিন্ন টোল কালেকশনের ক্ষেত্রেও এটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

কর ফাঁকি, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাসে অর্থায়নের মতো লেনদেন হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নগদ ব্যবস্থায়। যে কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ক্যাশলেস বা লেস ক্যাশ লেনদেনের দিকে গেছে। ব্যাংকের পাশাপাশি এমএফএস, অ্যাপসহ বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশও সে চেষ্টা চলছে। নগদ লেনদেন কমাতে বেশ আগে থেকে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিনিময় প্ল্যাটফর্ম এ ব্যবস্থায় লেনদেনকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেবে। ব্যাংকগুলোর অনলাইন ব্যবস্থা ব্যবহার করে এক শাখা থেকে আরেক শাখার গ্রাহক বা আরেক ব্যাংকের গ্রাহককে পরিশোধ করা যায়। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের চারটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। চারটি প্ল্যাটমর্ফই কেবল ব্যাংক থেকে ব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। বাংলাদেশ অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেম (বিএসিপিএস), বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (বিইএফটিএন), ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ এবং রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) ব্যবস্থার প্রতিটিতে ব্যাংকের উপস্থিতির দরকার হয়।

যুক্ত হয়েছে যেসব ব্যাংক
গত রোববার উদ্বোধনের দিন ১২টি প্রতিষ্ঠান এ ব্যবস্থায় যুক্ত ছিল। এক সপ্তাহ না পেরুতেই যুক্ত হয়েছে আরও তিনটি। বর্তমানে ১১টি ব্যাংক, তিনটি এমএফএস ও একটি পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার রয়েছে তালিকায়। ব্যাংক হলো- সোনালী, ইসলামী, ব্র্যাক, দ্য সিটি, ডাচ্‌-বাংলা, ইউসিবি, ইস্টার্ন, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ও মিডল্যান্ড ব্যাংক। তিন এমএফএস প্রতিষ্ঠান হলো- বিকাশ, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের রকেট ও ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশ। এর বাইরে 'টালি পে' নামে একটি পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) যুক্ত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যবস্থা চালুর মাত্র পাঁচ দিন হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। ওই দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ প্ল্যাটফর্ম থেকে ৬৩ হাজার ৫০০ জন ভার্চুয়াল আইডি খুলেছেন। পরিশোধ করেছেন ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। বিনিময় প্ল্যাটফর্মে লেনদেনে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে।

অপেক্ষায় আরও ১৪ প্রতিষ্ঠান
আরও ৯টি ব্যাংকসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান বিনিময় প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই, পরীক্ষামূলক লেনদেনসহ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণের পর তাদের যুক্ত হওয়া না-হওয়ার বিষয়টি বিবেচিত হবে। আবেদন করা ব্যাংকগুলো হলো- রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ও জনতা, বেসরকারি ব্যাংক এশিয়া, যমুনা, ন্যাশনাল, আইএফআইসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও এসআইবিএল। ডি মানি বাংলাদেশ ও আইপে সিস্টেম নামে পিএসপি যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ইউসিবিএলের এমএফএস সেবা 'উপায়' আবেদন করেছে। এ ছাড়া এমএফএস সেবা 'নগদ' আবেদন করলেও তাদের যুক্ত করা হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির এমএফএস সেবা পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন অনাপত্তি দিয়েছে ডাক বিভাগকে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন জানতে পারছে প্রতিষ্ঠানটিতে ডাক বিভাগের কোনো মালিকানা নেই। কেবল আয়ের একটি অংশ দেওয়া হচ্ছে ডাক বিভাগকে।