বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ বলছে- 'নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।' আর ১২৬ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা- 'নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।'
এদিকে সংবাদমাধ্যম বলছে- গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংক্ষেপে আরপিও নামে পরিচিত নির্বাচনী আইনের বেশ কিছু ধারা সংশোধনে নির্বাচন কমিশন আগস্ট মাসে একটি খসড়া বিল নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানালেও 'পাত্তা' দিচ্ছে না মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়; বিলের অগ্রগতি জানতে নির্বাচন কমিশন দুইবার চিঠি দিলেও তার জবাব মিলছে না। (সমকাল, ২৭ নভেম্বর, ২০২২)। ফলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার দায়িত্ব পালন না করে নির্বাহী বিভাগ কার্যত সংবিধান লঙ্ঘন করছে কিনা?
বিদ্যমান আরপিওতে যেসব সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভোট বাতিলে ইসির ক্ষমতা ও ভোট বন্ধে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানো; প্রার্থীর এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখালে বা কেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে শাস্তির বিধান; সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে শাস্তি; দায়িত্বে অবহেলায় কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতা বাড়ানো; প্রার্থীদের আয়কর সনদ বাধ্যতামূলক করা; ভোট গণনার বিবরণী প্রার্থী ও তাঁর এজেন্টদের প্রদান বাধ্যতামূলক করা; মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন পর্যন্ত খেলাপি বিল (বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি) পরিশোধের সুযোগ ইত্যাদি। আগস্টে পাঠানো এসব প্রস্তাবের পর অক্টোবরেও ইভিএম সংক্রান্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়েছে, ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোট ভোটারের সর্বোচ্চ ১ শতাংশকে কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে ভোট প্রদানের অনুমতি দিতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন আরও কিছু সংশোধনী চেয়েছিল। যেমন ঋণ ও বিলখেলাপিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না দেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরোধিতার মুখে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে ইসি।
আরপিও সংশোধনের জন্য যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, নিঃসন্দেহে সেগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মন্ত্রণালয় কেন চার মাসেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না- সেটিই প্রশ্ন। দু'বার চিঠির জবাব না পেয়ে এবার কমিশন আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জবাব দিতে সময় বেঁধে দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় সহযোগিতা না করলে জনমনে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় জাগবে। ২৭ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের উপসচিব আব্দুল হালিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, তাদের অনুরোধ ও চাহিদা উপেক্ষিত হলে কমিশন দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না।
প্রস্তাবিত সংশোধনী সংবলিত বিলটি পাস হবে কি হবে না, সেটি সংসদের এখতিয়ার। অর্থাৎ বিলটি সংসদে উত্থাপিত হবে। এর পর স্পিকার এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদের স্থায়ী কমিটিতে পাঠাবেন। কমিটির সদস্যরা এটি নিয়ে আলোচনা করবেন। কোনো সংশোধনী থাকলে কমিটি সেটি সংসদে পেশ করবে। সব শেষে আইনমন্ত্রী বিলটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করবেন। তখন কণ্ঠভোটে 'হ্যাঁ' জয়যুক্ত হলেই বিলটি পাস হবে। মানে আইনে পরিণত হবে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যেসব সংশোধনী চেয়েছে, হুবহু সেগুলোই পাস হয়ে যাবে- এমনটা নাও হতে পারে। পাস হলেও এটি এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কিন্তু আগস্ট মাসে ইসি বিলের খসড়া পাঠানোর পর যে প্রায় চার মাস সময় অতিবাহিত হলো, এর কী যুক্তি?
অস্বীকার করার সুযোগ নেই- নির্বাচন কমিশন আইনত যত স্বাধীন ও নিরপেক্ষই হোক না কেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নির্ভর করে মাঠ প্রশাসনের ওপর। আরও স্পষ্ট করে বললে আমলা ও পুলিশের ওপর। আর এই মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাহী বিভাগ। সুতরাং নির্বাহী বিভাগ যদি সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের বিধান মেনে ইসিকে সহায়তা না করে এবং ইসিকে সহায়তা না করার অপরাধে যদি মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের শাস্তির বিধান না থাকে, তাহলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে সম্ভব?
বস্তুত সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি সুস্থ সংস্কৃতি দরকার। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এটা গড়ে তোলা অসম্ভব এবং এটি এক দিনে বা এক বছরে সম্ভব নয়। এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের পর অন্তত সেটুকু ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে প্রথমত, দ্বিতীয়ত ও তৃতীয়ত যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেই নির্বাচন কমিশনের পাশে দাঁড়াতে হবে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকেই।
গত ফেব্রুয়ারিতে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাঁদের কথাবার্তা ও কাজকর্মে স্পষ্ট- তাঁরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি বিগত দুই নির্বাচনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিতে চান না। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে সেই কাজটি করা যে বেশ কঠিন- সেটি তাঁরা সম্ভবত ইতোমধ্যে উপলব্ধি করেছেন। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন। কিন্তু অনির্বাচিত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনও যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়- তাও ওয়ান-ইলেভেন সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট।
গণতন্ত্রের স্বার্থে 'অগণতান্ত্রিক' সরকারের বিধান তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে। এখন দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই। কমিশন যদি সাংবিধানিকভাবে সত্যি সত্যিই স্বাধীন না হয় এবং নির্বাহী বিভাগের আচরণে যদি মনে হয়, তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে পাত্তা দিচ্ছে না; তখন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের মতো অগণতান্ত্রিক বিধানের প্রতিই সমর্থন বাড়তে থাকবে।
আমীন আল রশীদ :সাংবাদিক ও লেখক