ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

চাল আমদানি নিয়ে ধোঁয়াশা

চাল আমদানি নিয়ে ধোঁয়াশা

বাহরাম খান ও জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩:৪৪

ধেয়ে আসছে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট। এমন আশঙ্কার বার্তা এখন আন্তর্জাতিকভাবেই আলোচিত। এ পরিস্থিতিতে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোতে ধরনা দিচ্ছে অনেককেই। অগ্রিম টাকা দিয়েও কিছু দেশ চাল কেনা নিশ্চিত করছে। বাংলাদেশও বসে নেই। চাল আমদানির জন্য নতুন উৎসের খোঁজ চলছে। এরই মধ্যে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড ঘুরে এসেছেন খাদ্যমন্ত্রী ও সচিব।

চালের যে কোনো সংকটে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতে সম্পর্ক উন্নয়নই ওই তিন দেশ সফরের মূল লক্ষ্য ছিল মন্ত্রী ও সচিবের। এ বিষয়ে অগ্রগতির তথ্য এখনও জানা যায়নি। গত রোববার বিদেশ সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন ডেকেও তা স্থগিত করেন খাদ্যমন্ত্রী।

সরকারি মজুতে চালের যে অবস্থা, তা সন্তোষজনক বলা হচ্ছে। গেল রোববার পর্যন্ত সরকারি গুদামে মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ১৬ লাখ ১২ হাজার ৪৯৬ টন। এর মধ্যে গম আছে ৩ লাখ ৭ হাজার ৯৪ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত বোরো মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছে। আমনেও বাম্পার ধান ঘরে উঠবে। তবে বাজারে চালের দাম প্রত্যাশিত সীমায় না থাকায় সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়ছেই। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা মনে করছেন, সংকটের সময়
বিদেশ থেকে তাৎক্ষণিক চাল পাওয়া কঠিন হবে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি দেশীয় বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা চলছে। শিগগিরই এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে মতবিনিময় করার পরিকল্পনা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি চাল আমদানির নতুন দেশ নিশ্চিত করতে চাইছে সরকার।

সফরের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত সোমবার সমকালকে বলেন, 'আমাদের বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। নতুন আমন ধানেরও ভালো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এগুলো দেখে পরবর্তী আমদানির বিষয়ে চিন্তা করব।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এটা ঠিক যে ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মিসরসহ বেশ কিছু দেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গুরুত্ব দিয়ে চাল কিনছে। আমাদেরও প্রস্তুতি আছে। তিন দেশ আমাদের চাল দিতে রাজি আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ-সংক্রান্ত অগ্রগতি আসবে আশা করি।' দেরি হয়ে যাচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সাধন চন্দ্র বলেন, 'আমরা তিন দেশ ঘুরে এসেছি। এখন নিজেরা পর্যালোচনা করে প্রধানমন্ত্রীকে জানাব। এরপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।'

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে থাইল্যান্ড থেকে ৫ লাখ টন চাল আমদানি করেছে ইন্দোনেশিয়া। তবে বাংলাদেশ দুই লাখ টন চাল থাইল্যান্ড থেকে আমদানির চেষ্টা করলেও এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।
নতুন উৎসের খোঁজ :মন্ত্রী-সচিবের সফর করা তিনটি দেশের মধ্যে আগে থেকেই কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত আছে। দেশটি বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী চাল রপ্তানি করতে রাজিও আছে। তবে কম্বোডিয়ার রপ্তানি ক্ষমতা মাত্র ১০ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে সিংহভাগই আতপ চাল, বিপরীতে বাংলাদেশের চাহিদা সেদ্ধ চাল। তাই বিশেষ পরিস্থিতিতে এ দেশ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন চাল চাইলে পাবে বাংলাদেশ।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, কম্বোডিয়ায় মাত্র পাঁচটি সেদ্ধ চালের মিল আছে। এর মধ্যে এখন চালু আছে দুটি। বাংলাদেশ যদি কম্বোডিয়ার চাল আনতে চায়, তাহলে সে দেশের সরকারকে সেদ্ধ চালের জন্য নতুন করে মিল চালু করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে দীর্ঘমেয়াদি চাল কেনার কোনো চুক্তি হলে এবং বাংলাদেশকে নিজ খরচে কম্বোডিয়ায় সেদ্ধ চালের মিল স্থাপন করতে হবে। সেদ্ধ চাল রপ্তানি করতে কম্বোডিয়া নিজেরা কোনো বিনিয়ো করবে না। কারণ, কম্বোডিয়া বেশিরভাগ চাল রপ্তানি করে ইউরোপের দেশগুলোতে। সেখানকার চাহিদা থাকলে বাংলাদেশের জন্য আলাদাভাবে তাদের কিছু করার সম্ভাবনা কম। এর কারণ উল্লেখ করে সূত্র জানায়, কম্বোডিয়া থেকে সর্বশেষ ২০১৭ সালে চাল আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। পাঁচ বছর পর এখন আবার চেষ্টা চলছে। অর্থাৎ কম্বোডিয়ার কাছে বাংলাদেশ অনিয়মিত ক্রেতা। তাই তাদের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কোনো চুক্তি ছাড়া সংকটের সময় চাল চাইলেই পাওয়া যাবে- এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে কম্বোডিয়ার জমি ব্যবহার করে ধান উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে বলে দেশটির পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যেখানে কৃষি ভর্তুকি দিয়েই কূল পাচ্ছে না বাংলাদেশ, সেখানে বিদেশের মাটিতে ব্যবহার করে কৃষিকাজের ঝুঁকি নেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

ভিয়েতনামের কাছ থেকে এখন সরকারিভাবে চাল আমদানি করছে বাংলাদেশ। ভিয়েতনামেও আতপ চালের জোগান বেশি। দেশটির সঙ্গে থাকা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ মোট ২ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানি করছে। এর মধ্যে ৩০ হাজার টন আতপ চাল ভিয়েতনাম নিজেরা দিচ্ছে। বাকি ২ লাখ টন সেদ্ধ চাল থাইল্যান্ড থেকে কিনে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করছে তারা। ভিয়েতনামের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের চাল কেনায় বাংলাদেশকে বেশি খরচ করতে হচ্ছে। চাল আমদানির ক্ষেত্রে ভিয়েতনামও খুব বড় ভরসার জায়গা নয়। কম্বোডিয়ার মতো সীমিত পরিমাণ রপ্তানি করে ভিয়েতনাম। তবু দেশটি থেকে চাল আমদানির বিষয়ে আশাবাদী খাদ্য মন্ত্রণালয়। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ চাইলে প্রয়োজনে অন্য দেশ থেকে আমদানি করে সেদ্ধ চাল দিতে পারবে তারা।

চাল আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এখন বড় নজর থাইল্যান্ডের দিকে। তবে এর আগে থাইল্যান্ড থেকে জিটুজি পদ্ধতিতে চাল কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বাংলাদেশ সেই চাল কেনেনি। বিষয়টিতে থাইল্যান্ড ক্ষুব্ধ। তাই এই অর্থবছরে থাইল্যান্ড থেকে সরাসরি চাল আমদানির চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় প্রত্যাশিতভাবে সাড়া দেয়নি তারা। ফলে ভিয়েতনামের মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে দুই লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। এবার মন্ত্রী-সচিবের সফরের মাধ্যমে আস্থার সেই সংকট কাটানোর চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে। সে চেষ্টা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানা যায়নি।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, থাইল্যান্ড সরাসরি বাংলাদেশকে, অর্থাৎ 'সরকার থেকে সরকার' (জিটুজি) চাল দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। থাইল্যান্ড সরকারের নির্ধারিত এজেন্টদের মাধ্যমে চাল কিনতে হবে বাংলাদেশকে। বর্তমানে চাল রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। তারা চাহিদা অনুযায়ী সেদ্ধ বা আতপ চাল দিতে পারে।

চাল আমদানির নতুন উৎস খোঁজার বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন গত রোববার সমকালকে বলেন, 'এবারের সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। এখনই চাল কিনতে হবে বা কী পরিমাণ কিনব- এমন কোনো উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না। আমরা দেশগুলো সফর করে বুঝতে চেয়েছি, আমাদের বিশেষ প্রয়োজনের সময় তারা চাল দিতে পারবে কিনা, দিলে সেটার প্রক্রিয়া কী হবে।' এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, 'এখন সফরের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নিজেরা বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।' বিপদের সময় ওই সব দেশ থেকে চাল পাওয়া যাবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্য সচিব বলেন, 'আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে ইতিবাচক বার্তাই পেয়েছি। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি এই দেশগুলো খুবই ইতিবাচক। এখন কার্যক্ষেত্রে কতটা ফল পাওয়া যায়, দেখা যাক।'

ভারত ও মিয়ানমারে চোখ :এই অর্থবছরে ভারত থেকে এক লাখ টন চাল আমদানির কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশের চাহিদামতো চালের জন্য ভারত সবচেয়ে বড় আশার জায়গা। তবে অতীতের আমদানি অভিজ্ঞতায় ভারতের লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতাকে অনভিপ্রেত মনে করছে খাদ্য অধিদপ্তর। তাই এক দেশ নির্ভর আমদানির বৃত্ত থেকে বের হতে নতুন উৎস খুঁজতে বের হয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী ও খাদ্য সচিব। আমদানির নতুন উৎস তৈরি হলেও ভারতের প্রতি সব সময়েই ইতিবাচক দৃষ্টি রাখছে বাংলাদেশ। গতকাল মঙ্গলবার নতুন করে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির আন্তর্জাতিক দরপত্র দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই আগ্রহ দেখাবে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে দুই লাখ টন চাল আমদানি করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর বাইরে আরও আমদানির সুযোগ আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আমদানির চাল আসছে :খাদ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সরকারিভাবে ভারত, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানি হচ্ছে। এরই মধ্যে অর্ধেকের বেশি চাল চলে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে এসেছে ২ লাখ ৬৯ হাজার টন চাল। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারিভাবে আমদানির প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। বাকি চালও পাইপলাইনে আছে। সরকারের প্রত্যাশিত সময়ে চাল দেশের গুদামে পৌঁছাবে।
তবে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির গতি অনেকটাই মন্থর। সরকারের তরফ থেকে বেসরকারিভাবে মোট ১৫ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে এসেছে মাত্র ৩ লাখ ৫৩ হাজার টন চাল।


আরও পড়ুন

×