তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ রমজানে বেশি প্রয়োজনীয় ৮ পণ্যের আমদানিতে এলসি মার্জিন বা নগদ জমা নূ্যনতম পর্যায়ে রাখা এবং এসব পণ্য ৯০ দিনের বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। গতকাল এলসি মার্জিনে ছাড় দেওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে চাল ও গম। তবে ভোগ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ ধরনের সুযোগ আগে থেকেই পেয়ে আসছে। ফলে এ নির্দেশনায় আমদানির ক্ষেত্রে সংকট কাটবে না বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা। তাঁরা ডলার সংস্থানেই এর সমাধান দেখছেন। পণ্য আমদানির জন্য ডলারের সরবরাহ বাড়ানোই জরুরি মনে করছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এরই মধ্যে রোজার আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সংস্থানের দাবি জানিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি দুটি সার্কুলারের মাধ্যমে রমজানে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দুই ধরনের সুবিধা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, ডাল, মটর, পেঁয়াজ ও মসলা ৯০ দিনের বাকিতে আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গতকাল আলাদা সার্কুলারের মাধ্যমে চাল ও গমের এলসি খোলার ক্ষেত্রে মার্জিনের হার নূ্যনতম পর্যায়ে রাখতে বলা হয়েছে।

ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা জানান, এলসি মার্জিন শূন্য বা কম রাখা কিংবা বাকিতে পণ্য আমদানির সুযোগ আগে থেকেই রয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে এসব পণ্য এনে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে ছাড়ে, তারা শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এখন সাপ্লায়ার্স ও বায়ার্স ক্রেডিটের বিপরীতে ৩৬০ দিন পর্যন্ত বাকিতে আমদানি করতে পারে। ফলে বড় আমদানিকারকদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা ভিন্ন কোনো সুবিধা দেবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে পণ্য এনে বাণিজ্যিকভাবে সরাসরি বাজারে বিক্রি করে তাদের জন্য হয়তো কিছুটা সহায়ক হবে। তবে গ্রাহক চাইলেও ব্যাংক রাজি হবে কিনা তা দেখার বিষয়। কেননা, আগামীতে পরিস্থিতি কী হবে সে ভাবনা থেকে বেশিরভাগ ব্যাংক এখন এ ধরনের সুযোগ দিতে চাইছে না।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ভোগ্যপণ্যে শূন্য মার্জিন এবং বাকিতে এলসি খোলার সুযোগ আগে থেকেই আছে। তবে এখন ব্যাংক ডলার সংস্থান না করে কোনো এলসি খুলতে চাইছে না। ফলে এখন মূল ইস্যু ডলারের সরবরাহ বাড়ানো। শূন্য মার্জিন বা বাকিতে এলসি খোলা ব্যাংকের জন্য কোনো ইস্যু নয়। ব্যাংকগুলো আশা করে, রমজানের আগে প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সহায়তা দেবে।

চট্টগ্রামের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী সমকালকে বলেন, শূন্য মার্জিন বা বাকিতে এলসি খোলার সুবিধা ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই পেয়ে আসছেন। তবে বাণিজ্যিকভাবে যাঁরা পণ্য আমদানি করেন তাঁরা এতদিন নগদ বা সাইট এলসির বিপরীতে আমদানি করছিলেন। তাঁরা হয়তো এখন ৯০ দিনের বাকিতে এলসি খুলতে পারবেন। তিনি বলেন, সাধারণত বাংলাদেশি ব্যাংকের পক্ষে বিদেশি ব্যাংক দেরিতে পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয়। তবে এখন বেশিরভাগ বিদেশি ব্যাংক বাকিতে এলসি খুলতে চাইছে না। যে কারণে সুবিধা দেওয়া হলেও বিদেশি ব্যাংক না চাইলে এর কোনো সুফল মিলবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আগে থেকে এ সুযোগ ছিল। কিন্তু রমজান সামনে রেখে ব্যাংকগুলো যাতে প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খুলতে এলসিতে সুবিধা দেয়, তার জন্য নতুুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সার্কুলারের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক একটি স্বস্তি পাবেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যাংকাররা জানান, বিদেশি অনেক ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে ডেফার্ড বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে এলসি নিতে চাইছে না। আবার ডলার নিয়ে অনিশ্চয়তায় দেশীয় ব্যাংকও ঝুঁকি নিতে চাইছে না। কেননা কোনো কারণে পরিশোধের সময় ডলার না পেলে ওই ব্যাংককেই সংকটে পড়তে হবে। যে কারণে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা চাইছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সংস্থানের নিশ্চয়তা। তবে রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতিসহ নানা কারণে এখনই এ নিয়ে কোনো কিছু বলছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৬৩০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ডলার। এর প্রায় সবই দেওয়া হয়েছে সার, জ্বালানিসহ সরকারের বিভিন্ন পণ্য আমদানির বিপরীতে। ফলে ডলার আয় নেই এমন আমদানিকারক বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহকারীরা এলসি খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। কোনো কোনো ব্যাংক মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের বাইরে অন্য এলসি খুলতে চাইছে না।

ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান সমকালকে বলেন, মেঘনা গ্রুপ বাল্ক্ক আকারে আমদানি করে। ফলে চার-পাঁচটি ব্যাংকে এক সঙ্গে এলসি খুলতে হয়। ডলার পেতে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছেন। তিনি জানান, ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে আগে থেকেই তাঁরা শূন্য মার্জিনে এলসি খোলার সুযোগ পেতেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানেও তাঁরা তিন বা ছয় মাসের বাকিতে আমদানি করেন। তবে এর বিপরীতে ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হয়। এ ছাড়া তাঁদের বাজার থেকে কিনে ডলার পরিশোধ করতে হয়। ফলে এখানে একটা ঝুঁকি থাকে। এখন হয়তো ১০৬ টাকায় ডলার কিনতে পারছেন। তিন বা ছয় মাস পর তা ১১২ টাকা হয়ে গেলে আমদানিকারক লোকসানে পড়েন। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুবিধা দিলেও সবাই নেবে কিনা, তা দেখার বিষয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, নানা উদ্যোগের পর নতুন এলসি খোলা সামান্য কমলেও আগের দায় পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বেশিরভাগ ব্যাংক। যে কারণে বাণিজ্য ঘাটতি ও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৫৯ কোটি ডলার। এ ছাড়া দেশের চলতি হিসাবে ৪৫০ কোটি ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি হয়েছে ৪৮৭ কোটি ডলার। এসব কারণে গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।