সাধারণ বিনিয়োগকারী তো বটেই, টালমাটাল শেয়ারবাজারে পেশাদার ও অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী হিসেবে খ্যাত সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোও তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারছে না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তালিকাভুক্ত ৩৬ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১৭টিই লোকসান করেছে। ছয় হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়েও ৩৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা লোকসান করেছে এসব ফান্ড। তালিকাভুক্ত মেয়াদি ফান্ডগুলোর প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র মিলেছে।

পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত নগদ লভ্যাংশের টাকায় গড়া শেয়ারবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল থেকে গোল্ডেন জুবলি মিউচুয়াল ফান্ড নামে ১০০ কোটি টাকা আকারের যে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করা হয়েছে, সেটির অবস্থাও ভালো নয়। এ ফান্ড শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করা তো দূরের কথা, নিজেই লোকসানে পড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ক্রয়মূল্যের হিসাবে এ ফান্ডের সম্পদমূল্য ছিল ৯৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু বাজারমূল্যে ফান্ডটির সম্পদমূল্য ৮০ লাখ টাকা কমে ৯৯ কোটি ১০ লাখ টাকায় নেমেছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবসায় এ লোকসান। ফান্ডটির ব্যবস্থাপনায় আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির সহযোগী আইসিবি এএমসিএল।

শুধু গোল্ডেন জুবলি ফান্ড নয়, একই দশা প্রায় সব ফান্ডের। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মোট মূলধন ৫ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। অথচ গতকাল মঙ্গলবার দিনের শেষে এসব ফান্ডের মোট মূল্য ছিল ৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা, যা মূলধনের ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ টাকা মূল্যের মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট গড়ে ৬ টাকা ৯০ পয়সায় কেনাবেচা হচ্ছে, যদিও এই ৩৬ ফান্ডের মধ্যে ২৪টি গত ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে শেয়ার ব্যবসা করছে।

এ খাতসংশ্নিষ্টরা জানান, গত বছরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন শুরু হওয়ার পর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো ফান্ডগুলোও ব্যবসা করতে পারছে না। ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ক্রেতার অভাবে সিংহভাগ শেয়ারের কেনাবেচা হচ্ছে না। এ অবস্থায় মুনাফার চিন্তা ছেড়ে লোকসান কতটা হয়, সে অঙ্ক কষতে হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির লোকেরা নিজেদের পেশাদার ও অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী বলে দাবি করেন। অভিজ্ঞ হলে কেন তারা মুনাফা করতে পারেন না! ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করে বছরে যদি ৫-৭ শতাংশ বা তারও কম মুনাফা মেলে, তাহলে মানুষ কেন ব্যাংকে টাকা না রেখে এমন সব ফান্ডে বিনিয়োগ করবে।

আবু আহমেদ বলেন, প্রতিবেশী ভারতসহ অন্য সব দেশে মানুষ নিজে সরাসরি শেয়ারে বিনিয়োগ না করে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন। কারণ সেখানে ফান্ড ম্যানেজাররা দক্ষ ও অভিজ্ঞ। তাঁরা মুনাফা করে দিতে পারেন। বাংলাদেশে যা উল্টো। এখানে ১০ বছরের জন্য টাকা নিয়ে মেয়াদ শেষে মানুষকে টাকাও ফেরত দেওয়া হয় না। আইন বদলে মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ কারণে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোকে মানুষ বিশ্বাস করে না। নিজেরা যা পারে ততটাই বিনিয়োগ করে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গড়ে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পরিচালিত মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সম্পদমূল্য পুঁজির তুলনায় খুব বেশি বাড়াতে পারেনি। ফান্ডগুলোর ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার শেষে বাজারমূল্যে ৩৬ ফান্ডের মোট সম্পদমূল্য ছিল ৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। আর ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে মোট সম্পদমূল্য ছিল ৬ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ক্রয়মূল্য থেকে লোকসান ২৮০ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

অবশ্য ফ্লোর প্রাইস আরোপের আগে গত ২৮ জুলাই শেষে বাজারমূল্যে ৩৬ ফান্ডের মোট সম্পদমূল্য ছিল ৬ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। বিপরীতে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে সম্পদমূল্য ছিল ৬ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা।

সর্বশেষ হিসাব বছরে এসব ফান্ড বিনিয়োগকারীদের ৩৯৮ কোটি টাকা নগদ মুনাফা বিতরণ করেছে। মোট মূলধনের বিপরীতে ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ নিট মুনাফার বিপরীতে ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করেছে তারা। অর্থাৎ পুঁজি থেকেও লভ্যাংশ বিতরণ করেছেন ফান্ড ম্যানেজাররা।