- অর্থনীতি
- দুর্নীতি ও অর্থ পাচার অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত করেছে
সাক্ষাৎকার
দুর্নীতি ও অর্থ পাচার অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত করেছে

রিজওয়ান রাহমান
ঢাকা চেম্বারের সদ্য সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকারি এবং বেসরকারি খাতের এ মুহূর্তের করণীয় নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু হেনা মুহিব।
সমকাল: অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কেমন দেখছেন?
রিজওয়ান রাহমান: অর্থনীতি এখন চতুর্মুখী সংকটে রয়েছে। করোনা দিয়ে শুরু। এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ- এ রকম একের পর এক অভিঘাত আসছেই। চীনে আবার করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যু বেড়েছে। ব্রিটেনে সংক্রমণ বাড়ছে। বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কারণ, আন্তর্জাতিক সংকটের অভিঘাত বাংলাদেশে এখন আগের চেয়ে বেশি। কারণ, আমদানি-রপ্তানিসহ সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব বেড়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক ঘটনা বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিতে নাড়া দেয়। সব মিলিয়ে সার্বিক অর্থনীতির গতি কিছুটা ধীর।
সমকাল: আন্তর্জাতিক এ পরিস্থিতিতে কিছু দেশ তেমন সংকটে পড়েনি। বাংলাদেশ কেন এত সংকটে পড়ল?
রিজওয়ান রাহমান: এর কারণ ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা। দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার অর্থনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করেছে। ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ জালিয়াতির মারাত্মক ঘটনা ইসলামী ব্যাংকে ঘটল। এসব বিষয় স্বচ্ছতার সঙ্গে নজরদারিতে আনতে হবে। ঘটনা ঘটে গেলে ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে বলব, বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু রপ্তানি বাড়াতে আমদানি তো করতেই হবে। কোনো কোনো রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে ৭০ শতাংশের মতো বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন হয়। এ অবস্থার উত্তরণ দরকার। অন্যদিকে, বাড়তি দর পাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডির দিকে প্রবাসীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। এখানেও বিশেষ নজর দরকার। আর রপ্তানির ক্ষেত্রে একক পণ্য এবং সীমিত বাজারনির্ভরতাও বড় ঝুঁকি। এখনও আমাদের প্রধান বাজার ইউরোপ এবং আমেরিকা। আর রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। ইউরোপ-আমেরিকায় চাহিদা কমে গেলে আমাদের রপ্তানি কমে যায়।
সমকাল: পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে এখন করণীয় কী?
রিজওয়ান রাহমান: ব্যাংকিং খাতে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশের ঋণমান কমে যেতে পারে। এর অভিঘাত দীর্ঘদিন থাকবে। সংকট মেটাতে সরকার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাইকার মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ আনার চেষ্টা করতে হবে।
সমকাল: সরকার আর কী কী করতে পারে?
রিজওয়ান রাহমান: অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সব পক্ষের সমন্বয়ে একটি কমিটি করতে পারে সরকার। যাতে করণীয় নির্ধারণ করে পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেওয়া যায়। জাতীয় একটি জবাবদিহিতা কমিশনও করা যেতে পারে। যাতে সরকারি ও বেসরকারি সব খাত কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য হয়। ডলারের অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে দরের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এতে সাময়িক কিছুটা সংকট হলেও পর্যায়ক্রমে বিনিময় হারে একটা সমন্বয় তৈরি হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা কমিয়ে আনতে বড় রপ্তানি বাজারগুলোর সঙ্গে 'কারেন্সি সোয়াপ' করা যায়। কোনো কোনো দেশ হয়তো সহজে রাজি হবে না। এজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। আর আমি বলব, সরকার বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশের বাইরে 'রোড শো' করছে। এর চেয়ে বেশি দরকার স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া। স্থানীয় বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার কোনো কারণ নেই।
সমকাল: বেসরকারি খাতের পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
রিজওয়ান রাহমান: আমাদের ব্যাংক ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। একই সঙ্গে কারখানার বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে। অথচ নিয়ন্ত্রণের নামে আমদানি কার্যত বন্ধ। ফলে উৎপাদনও অনেক কম। তবে আমাদের বেসরকারি খাত বেশ শক্তিশালী। পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে আমাদের। বেসরকারি খাত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেই।
সমকাল: নতুন বছর বিশ্ব অর্থনীতি আরও খারাপ যেতে পারে বলে পূর্বাভাস আছে। আবার জাতীয় নির্বাচনের বছর। এ বিবেচনায় গুরুত্ব বাড়ানো প্রয়োজন?
রিজওয়ান রাহমান: জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাতে যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই আমরা। এখনই দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো কূটনীতিকের সঙ্গে ঝামেলা চলছে। আমার সুপারিশ, কোনো কিছুই যাতে ব্যবসা-বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত না করে। রাজনৈতিক কারণে দেশের অর্থনীতি যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে নীতিনির্ধারকদের সতর্ক থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন