বিশ্বে যা নজিরবিহীন সেই ফ্লোর প্রাইসকে 'রক্ষাকবচ' বানিয়ে শেয়ারবাজারের দরপতন ঠেকাতে চেয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এখন সেই ফ্লোর প্রাইসেই ডুবছে শেয়ারবাজার, ডুবছে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিয়োগও। এই ফাঁদে পড়ে শেয়ারবাজারের তিন-চতুর্থাংশ শেয়ার প্রকৃত অর্থেই ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে, লেনদেন নেমেছে আড়াই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। 
গতকাল সোমবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পুরো দিনের লেনদেন দেড়শ কোটি টাকার নিচে নেমেছে, কেনাবেচা হয়েছে মাত্র ১৪৬ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, গত আড়াই বছরের ৬০৮ কার্যদিবসে মাত্র চার কার্যদিবসের লেনদেন ২০০ কোটি টাকা পার করেনি। গতকালের লেনদেন তারই একটি। এমন তিন লেনদেনের বাকি দুইটিই হয়েছে গত এক সপ্তাহে। ২০০ কোটি টাকা পার না করা চতুর্থ লেনদেনটি হয়েছিল ২০২০ সালের ৭ জুলাই, যার পরিমাণ ছিল ১৩৮ কোটি টাকা। গতকালের লেনদেন তার থেকে মাত্র ৮ কোটি টাকা বেশি।

ডিএসই জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত ৩৯২ শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে সোমবারে ৩২৯টির কেনাবেচা হয়েছে। তবে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, লেনদেনের শীর্ষ ১০ শেয়ারের কেনাবেচাই ছিল ৮৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা মোটের প্রায় ৫৮ শতাংশ। এর বাইরে লেনদেনের শীর্ষ ২০, ৫০ ও ১০০ শেয়ারের লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে মোটের সাড়ে ৭৬ শতাংশ, সাড়ে ৯৪ শতাংশ এবং ৯৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ লেনদেনের নিচের দিকের ২২৯ শেয়ারের কেনাবেচার পরিমাণ ছিল মাত্র ২ কোটি টাকা বা মোটের মাত্র ১ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ সিংহভাগ শেয়ারের কোনো কেনাবেচাই নেই। উপরন্তু ক্রেতার অভাবে ৬৩ কোম্পানির লেনদেনই হয়নি।

ফ্লোর প্রাইস নামক তথাকথিত রক্ষাকবচ এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্টরা। তাঁরা বলেন, শেয়ারবাজারের শেয়ারের দর বাড়বে-কমবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। ফ্লোর প্রাইস এ ব্যবস্থা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কৃত্রিমভাবে শেয়ারদর ধরে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার রোষানলে পড়ার ভয়ে এই 'সরল সত্য' কথাগুলোও নাম প্রকাশ করে বলতে রাজি হননি তাঁরা।
তবে সংকট যে গভীর থেকে গভীরতর হতে যাচ্ছে, তা অনুমান করে গত ২২ ডিসেম্বর তালিকাভুক্ত ৩৯২ শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্য থেকে ১৬৭টির নামে মাত্র ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এ ঘোষণা দিয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম সমকালকে বলেছিলেন, লেনদেন বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই কিছু শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হয়েছে। এমন সব শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তোলা হয়েছে, যেগুলোর বাজার মূলধন কম বলে সূচকের পতন হবে না বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, পরিস্থিতি এমন যে টাকার মায়া বিনিয়োগকারীদের থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেশি। এমনভাবে ফ্লোর প্রাইস তোলা হয়েছে, যাতে সেগুলোর দরপতন সূচকের পতনকে ত্বরান্বিত না করে। বাজার মূলধনে ওই ১৬৭ শেয়ার ও ফান্ডের অংশ ৫ শতাংশ হওয়ার পরও 'স্ট্যান্ডার্ড সার্কিট ব্রেকার' ফেলে নিচের সার্কিট ব্রেকার রাখা হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। অর্থাৎ নির্দিষ্ট দিনে ওই শেয়ারগুলোর দর ১ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না।

এর ফলে অন্য সব শেয়ারের পাশাপাশি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া শেয়ারের লেনদেন কমেছে বেশি। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার আগের দিন গত ২২ ডিসেম্বর যেখানে ওই ১৬৭ শেয়ারের ৫৮ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়েছিল, গতকাল তা ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় নেমেছে। তাছাড়া সার্বিক লেনদেন ২২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা থেকে দেড়শ কোটি টাকার নিচে। এখনও ২২৪ শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস কার্যকর আছে, এর মধ্যে পড়ে আছে ১৭৮টি।

শুধু কি ফ্লোর প্রাইসই বর্তমান শেয়ারবাজারের প্রধান সংকট- এমন প্রশ্নে ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও সমকালকে বলেন, অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে নানা শঙ্কাও একটি কারণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইসই বড় সমস্যা তৈরি করেছে।

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আগে শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা আয় বা ইপিএসের যে শেয়ারটি ১০০ টাকায় কেনাবেচা হয়েছিল, এখন তার ইপিএস ৩ টাকায় আসার পর বা নেমে আসার শঙ্কা থাকলে তখনও কি বিনিয়োগকারীরা ওই দরে শেয়ার কিনবেন? ফ্লোর প্রাইস এমনই ব্যবস্থা, যা ওই ১০০ টাকার কমে শেয়ার কেনার সুযোগ নেই। ফলে কেউ এ শেয়ার কিনছেনও না। পুরোপুরি ফ্লোর প্রাইস তুলে না দিলে বাজারের সংকট চলতে থাকবে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা, ব্যাংক খাতে লুটের কারণে মানুষ এখন ভয়ে ব্যাংকেও টাকা রাখতে ভয় পায়। দেশের সবচেয়ে বড় এবং ভালো ব্যাংকটি এখন দেউলিয়া হওয়ার অবস্থায়। আমানতকারীদের অনেকেই টাকা তুুলে নিচ্ছেন। টাকা তোলার চাপ সামলাতে শরিয়াহ ব্যাংক হয়েও সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার করেছে ইসলামী ব্যাংক। এসব তো ভালো লক্ষণ নয়। আবার এমন নয় যে, শেয়ারবাজারে কম লুটপাট হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে নেবেন, এটাই স্বাভাবিক।

শেয়ারবাজার বিশ্নেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আল-আমীন বলেন, অর্থনীতির মন্দ খবরের বাইরের কিছু বিষয়ও এ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর অন্যতম হলো- শেয়ার কারসাজি এবং সব জেনেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার চুপ থাকা এবং কারসাজির চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া। এ কারণে বিএসইসির প্রতি অনেক বিনিয়োগকারীর অনাস্থা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা যখন বিশ্বাস করতে শুরু করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের স্বার্থ না দেখে কারসাজির পক্ষে কাজ করছে, তখনও তাঁরা শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেনই।

শীর্ষ এক ব্রোকার জানান, গত শনিবার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তরে দেওয়া বিএসইসি চেয়ারম্যানের একটি সাক্ষাৎকারের নেতিবাচক প্রভাবও শেয়ারবাজারে আছে। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে আরও শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হবে। আর সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারের এমন টালমাটাল অবস্থার দায় বিএসইসির নয়। যদিও ২০২০ সালের কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজারের যে উত্থান হয়েছিল, তার কৃতিত্ব নিয়েছিলেন তিনি।

সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে, গতকাল লেনদেন হওয়া ৩২৯ শেয়ারের মাত্র সাতটির দর বেড়েছে, কমেছে ১৫৮টির। দর অপরিবর্তিত ছিল ১৬৪টির। এই ১৬৪টিসহ লেনদেন না হওয়া বাকি ৬৩টির সিংহভাগই ফ্লোর প্রাইসে পড়ে আছে।



বিষয় : লেনদেন তলানিতে ডুবছে পুঁজিবাজার ৩৯২ শেয়ারের তিন শতাধিকে ক্রেতা নেই

মন্তব্য করুন