- অর্থনীতি
- প্রণোদনার বীজে কৃষকের সর্বনাশ
প্রণোদনার বীজে কৃষকের সর্বনাশ

ফাইল ছবি
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যদুবয়রা ইউনিয়নের খড়িলার বিলের কৃষক তারিকুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছিলেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাঁকে এক কেজি বীজ সহায়তা দেওয়া হয়। ভেবেছিলেন পেঁয়াজ বিক্রি করে ভালো আয় হবে। কিন্তু তাঁর সেই আশা শেষ হয়ে গেছে। বীজতলা থেকে জমিতে রোপণের পর পেঁয়াজের গাছ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। জমির সব পেঁয়াজের চারা মরে গেছে।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের চন্দ্রপাড়া গ্রামের চাষি সেলিম হাওলাদার এ বছর কৃষি অফিস থেকে এক কেজি সরিষাবীজ নিয়ে ৮০ শতাংশ জমিতে বপন করেন। এরই মধ্যে সরিষা গাছ প্রায় এক হাত উঁচু হয়েছে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি বীজ থেকে চারা গজায়নি।
একই অবস্থা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাষিদের। বিনামূল্যে কৃষকের বীজ পাওয়ার আনন্দ পরিণত হয়েছে নিরানন্দে। এ নিয়ে চাষিরা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদেরই দায়ী করছেন। কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ক্ষতির কথা স্বীকার করলেও কিছুই জানে না মন্ত্রণালয়।
রবি ফসলের উৎপাদন বাড়াতে বিনামূল্যে বীজ সহায়তা দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এবার ৬৪ জেলার ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ কৃষক এ সুবিধা পান। বীজ বাবদ এবার ব্যয় হয়েছে ৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ ছাড়া বোরো ধানের হাইব্রিড (এসএল-৮এইচ) জাতের বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বীজ দেওয়া হয়। এর বাইরেও নানাভাবে দেওয়া হয় বীজ। এসব প্রণোদনার বীজই এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকের দুশ্চিন্তার কারণ।
কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা, পান্টি, চাঁদপুর, বাগুলাট, চাপড়া ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রণোদনার বীজে পেঁয়াজ চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষকরা। তাঁদের অভিযোগ, কৃষি অফিস প্রণোদনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে যে পেঁয়াজবীজ দিয়েছে, তা ভেজাল। দুই সপ্তাহ পার হলেও খোঁজ নেননি কৃষি কর্মকর্তারা।
যদুবয়রা ইউনিয়নের খড়িলার বিলে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করছেন চাষিরা। মাসখানেক আগে তাঁরা চারা রোপণ শুরু করেন। কিন্তু এ বছর চারায় শিকড় না হয়ে মাথার অংশ থেকে ধীরে ধীরে পুরো গাছ মরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। স্প্রে করেও চারা বাঁচানো যাচ্ছে না। ক্ষতি কাটাতে অনেকে ভুট্টাবীজ বপন করছেন। কৃষক জাহিদুর রহমান জানান, তাঁর ২৬ শতাংশ জমির সব চারা মরে গেছে। কৃষি কর্মকর্তাদের ফোন দিয়েও মাঠে আনা যায়নি।
বালিয়াপাড়া গ্রামের আবুল ব্যাপারীর ছেলে আব্দুর রশিদ বলেন, যত্ন করেও চারা হয়নি। তাঁর এলাকার প্রণোদনা পাওয়া কেউই পেঁয়াজ জন্মাতে পারেননি। চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান তুষার বলেন, প্রণোদনার বীজ পাওয়া কৃষকরা পথে-ঘাটে আমাকে লাঞ্ছিত করছেন। যদুবয়রা ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, তাঁর ইউনিয়নে ১৭ কৃষককে প্রণোদনার পেঁয়াজবীজ দেওয়া হয়েছিল। সবার চারা মরে গেছে।
কৃষকদের অভিযোগ নাকচ করে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাইসুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়াজনিত কারণে পেঁয়াজের চারা মরে যেতে পারে। কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার মটমুড়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামি ইউনিয়নের প্রণোদনা পাওয়া তিনজন কৃষক জানান, প্রণোদনা পাওয়া ৮০ শতাংশ কৃষকই চারা উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে আবাদে যেতে পারেননি তাঁরা।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের আবুল কালাম, কাছিপাড়া ইউনিয়নের দেওপাশা গ্রামের আলাউদ্দিন ও সালাম আকনের অভিযোগ, এক কেজি সরিষাবীজে অর্ধেকেও চারা হয়নি। তবে বাউফল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত হোসেন বলেন, বেশিরভাগ কৃষক তাঁদের পুরোনো ধ্যান-ধারণা দিয়ে বপন করায় চারা গজায়নি।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ১ হাজার ২০০ কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সবজিবীজ বিতরণ করে উপজেলা কৃষি বিভাগ। কিন্তু বীজে চারা গজায়নি বলে কৃষকদের অভিযোগ। সবজি লাগানোর মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
সারিয়াকান্দির চান্দিনা নোওয়ার গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদ জানান, তিনি পাঁচ শতক জমিতে লালশাকের বীজ বপন করেন। কিন্তু চারা গজায়নি। দিঘলকান্দি গ্রামের কৃষক জবেদ আলী জানান, তিনি ছয় শতক জমিতে পালংশাকের বীজ বপনের এক সপ্তাহ পার হলেও এখনও চারা গজায়নি।
সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বলেন, সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নে ৬০ জন কৃষককে সবজিবীজ দেওয়া হয়েছে। চারা না গজানোর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম বলেন, বীজগুলো বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে সরবরাহ করা হয়।
বিএডিসির ভুট্টাবীজে চারা না হওয়ার অভিযোগ ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের চাষিদের। এতে ১ হাজার ২০০ চাষির ৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে প্রায় ৬ হাজার ১০০ কৃষকের মাঝে হাইব্রিড জাতের ধানবীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। সময় পেরিয়ে গেলেও বীজ থেকে চারা গজায়নি। ফলে বোরো আবাদ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষকদের মাঝে। বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে এসব বীজ কেনা হয়। এসব কোম্পানির মধ্যে ব্যাবিলন অ্যাগ্রো অ্যান্ড ডেইরি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির 'ব্যাবিলন-২' নামের ধানবীজও ছিল। এ নিয়ে শতাধিক কৃষক অভিযোগ জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি অফিসে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে কোম্পানিকে জানালে ৭০ কৃষককে পুনরায় ধানবীজ সরবরাহ করা হয়। তবে এ সময় বীজতলা করে বোরো চাষ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কৃষকদের।
এসব বিষয়ে জানতে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (বীজ) প্রদীপ চন্দ্র দে-কে ফোন করা হলে তিনি বলেন, দেশের কোনো এলাকা থেকে এখনও এমন অভিযোগ আসেনি। সমকালের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন জেলার তথ্য তুলে ধরা হলে তিনি খবর নিয়ে ১০ মিনিট পর ফোন করে জানান, আমি একটি উপজেলায় খবর নিয়েছি। সেখানে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঠাব। সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, বীজগুলো কারা কীভাবে দিয়েছে তা খতিয়ে দেখে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে দেখবেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বরিশাল ব্যুরোর সুমন চৌধুরী, বগুড়া ব্যুরোর এসএম কাওসার ও কুমারখালী (কুষ্টিয়া) সংবাদদাতা মিজানুর রহমান নয়ন]
মন্তব্য করুন