
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের ওপর চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকায় বৃহস্পতিবার যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা নানা অর্থেই দেশের পরিবেশ আন্দোলনের জন্য 'এসিড টেস্ট'। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাকে 'তুচ্ছ' মনে হতে পারে- গাড়িতে সামান্য 'ঢিল' ছুড়েছে মাত্র। কিন্তু ঢিল ছুড়ে দুর্বৃত্তরা সম্ভবত দেখতে চাইছে, নিস্তরঙ্গ পুকুরে কতটা ঢেউ ওঠে। এই ঘটনা আমরা কীভাবে নিচ্ছি, তার ওপর আগামী দিনে পরিবেশ আন্দোলনের প্রতি দখলদার ও দুর্বৃত্তদের দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশে নির্ভর করতে পারে।
পরিবেশদূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের দৃঢ় অবস্থান ও উচ্চকণ্ঠ নতুন নয়। সভা-সমিতি, সংবাদমাধ্যমে তিনি প্রায় প্রতিদিন হুঁশিয়ারি ও প্রত্যয় ব্যক্ত করে চলেছেন। উচ্চ আদালতে গিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করছেন। চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিমসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যে পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে, তা নিয়েও তাঁর নেতৃত্বাধীন সংগঠন বেলা উচ্চ আদালতে রিট করেছিল। তিনিই যখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরীর একটি আবাসিক এলাকায় গিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে হামলার শিকার হন, তখন অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য।
সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে, পাহাড়খেকোরা ওই এলাকায় রীতিমতো পাহারা বসিয়েছে। বাইরের কেউ তাদের 'অনুমতি' ছাড়া প্রবেশ করতে পারে না। সেই 'জমিদারি' 'অমান্য' করে রিজওয়ানা হাসানের নেতৃত্বে পরিবেশবাদী ও সাংবাদিকদের একটি দল যখন সরেজমিন পরিস্থিতি দেখতে গেছে, তখন দখলবাজি ও মাস্তানির নেপথ্য খলনায়ক চসিক কাউন্সিলর জহুরুল আলম মারমুখী হয়ে উঠবেন না কেন?
মাত্র দেড় দশক আগে জসিম নাকি ইস্পাহানি মিলস লিমিটেড নামে একটি কারখানায় মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন; এখন তিনি শতকোটি টাকা ও বিপুল ভূ-সম্পত্তির মালিক (দেশ রূপান্তর, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩)। সবই কামিয়েছেন পাহাড় কেটে; প্রাকৃতিক প্রবাহ ভরাট করে; প্লট বানিয়ে বিক্রি করে। আর পরিবেশবাদীরা কিনা সেই 'আলাদিনের চেরাগ' হাত থেকে কেড়ে নিতে চায়!
অর্থ-বিত্তের পাশাপাশি গত দেড় দশকে রাজনৈতিক ক্ষমতাতেও ফুলেফেঁপে উঠেছেন জসিম। একসময় পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন; বর্তমানে তিনি একই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। ২০১৫ সালে চসিক কাউন্সিলরও 'নির্বাচিত' হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে- তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মারামারি, দখলবাজি, পাহাড় কাটাসহ বিস্তর অভিযোগে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ১০টির বেশি মামলা রয়েছে (দেশ রূপান্তর, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩)। বলা বাহুল্য, আরও অনেক অভিযোগকারী থানা পর্যন্ত যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারেন না। ওদিকে, খোদ পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ওই এলাকার তিনটি পাহাড়ের মধ্যে এখন মাত্র ২০ শতাংশ অবশিষ্ট রয়েছে। আর পাহাড় খেয়ে খেয়ে দখলদার জসিম এতটা দুর্বৃত্ত হয়ে উঠেছেন যে, কাউকে পরোয়া করছেন না। রিজওয়ানা হাসানের মতো দেশ-বিদেশে সুপরিচিত পরিবেশকর্মীর ওপর হামলায়ও তিনি কুণ্ঠাবোধ করছেন না।
বস্তুত দেশের নদী, জলাভূমি, বন, পাহাড়, মাঠ দখলকারীরা কীভাবে দিন দিন মারমুখী দুর্বৃত্ত হয়ে উঠছে- চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকাতেই তা প্রথম নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ দখলদারদের প্রবণতা যদি লক্ষ্য করি, গত দুই দশকে তাদের দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠার একটি চেনা ছক দাঁড়িয়ে গেছে।
প্রথমদিকে দেখা যেত- নদী, পাহাড় বা বনাঞ্চলের মতো সামষ্টিক সম্পত্তি দখল করা হতো রাতের আঁধারে। পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ বা প্রশাসনিক পদক্ষেপের মুখে তারা জাল দলিলপত্র হাজির করত নিজেদের সমর্থনে। অথবা এ ধরনের ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনকে ভিন্ন পন্থায় 'ম্যানেজ' করত। ফলে পরিবেশবাদীরা যত প্রতিবাদই করুন; দিনের শেষে তা অরণ্যে রোদনে পরিণত হতো। আক্ষরিক অর্থেই এমন শত শত নজির পাওয়া যাবে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে- প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্পত্তি গ্রাস করে দখলদাররা যখন অর্থ-বিত্ত ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন; প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়েই দখলবাজি করেন। পুলিশ ও প্রশাসনকে অর্থের জোরে শুধু নিবৃত্ত রাখলেও আর চলছে না। তাহলে তো ক্ষমতা প্রদর্শন হয় না! এই পর্যায়ে দখলদাররাই উল্টো পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে, ভিত্তিহীন মামলার মাধ্যমে, সামাজিকভাবে হেনস্তা ও হয়রানি করে প্রতিবাদকারী পরিবেশবাদীকে থামিয়ে দিতে চান।
এর 'ধ্রুপদি' উদাহরণ দেখা গিয়েছিল যশোরে; ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার তাঁর নির্বাচনী এলাকার একজন পরিবেশকর্মীকে 'ঠান্ডা' করতে কেশবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে টেলিফোনে বলেছিলেন- 'আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোন জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠান্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই।' (দৈনিক সমকাল, ৩০ জানুয়ারি ২০২১)। সংসদ সদস্যের ওই বক্তব্য 'ভাইরাল' হয়েছিল।
পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকারীদের পুলিশ বা প্রশাসন দিয়ে হেনস্তা করার ঘটনা যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে, সেটা বোঝা যায় সদ্যবিদায়ী বছরের দিকে নজর দিলে। গত বছর এপ্রিল মাসে রাজধানীর কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে পুত্রসহ কারাভোগ করেছিলেন সৈয়দা রত্না। পরের মাসেই নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় বলাইশিমুল গ্রামে খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন পরিবেশকর্মীরা। ওই বছর আগস্ট মাসে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরেও খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে গ্রামীণ গৃহবধূদের সন্তান ফেলে কারাগারে যেতে হয়েছিল।
তৃতীয় পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে- পরিস্থিতি আরও কঠিন। রাতের আঁধারে প্রাকৃতিক সম্পদ দখল বা জাল দলিলপত্রের আশ্রয় নয়; প্রকাশ্যে দখলবাজি করে পুলিশ ও প্রশাসনকে দিয়ে পরিবেশকর্মীদের হেনস্তাতেও শেষ নয়; ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গড়ে তুলে নিজেরাই পরিবেশকর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছে। চট্টগ্রামে এর সর্বসাম্প্রতিক নজির দেখা গেল। এমনকি দখলদার ও দুর্বৃত্তরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে, পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে যাওয়া পুলিশ ও প্রশাসনের ওপরেও চড়াও হচ্ছে। যেমন এই জানুয়ারি মাসেই কুমিল্লার লাকসামে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে বাধা দিতে গিয়ে ভূমি দপ্তরের তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারী হামলার শিকার হয়েছেন। (ডেইলি স্টার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩)।
চট্টগ্রামে পরিবেশকর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর পাহাড়খেকোর হামলাকে পরিবেশ আন্দোলনের জন্য 'এসিড টেস্ট' বলেছি এই নিবন্ধের শুরুতে। এখনই এদের দমাতে না পারলে পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন হয়ে উঠবে। আর তা শুধু পরিবেশকর্মী, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য নয়; খোদ রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যও হুমকিস্বরূপ। দখল-দূষণে দেশের নদী, জলাভূমি, পাহাড়, বন, মাঠ ইতোমধ্যে প্রায় অফেরৎযোগ্য ধ্বংসের মুখে চলে গেছে। ওদিকে দখলদাররা অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার জোরে হয়ে উঠছে বেপরোয়া। পরিবেশকর্মী দূরে থাক; তারা আইনকানুন, পুলিশ-প্রশাসনকেও পাত্তা দিচ্ছে না।
সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই দমন না করলে প্রকৃতিখেকোরা কীভাবে রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে- এ নজির আমরা লাতিন আমেরিকায় দেখেছি। বাংলাদেশে তার পুনরাবৃত্তি কেউ নিশ্চয় দুঃস্বপ্নেও চাইবে না।
শেখ রোকন: সম্পাদকীয় বিভাগপ্রধান, সমকাল; মহাসচিব, রিভারাইন পিপল
skrokon@gmail.com
মন্তব্য করুন