সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের পর তিন বছরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করা নিষিদ্ধের বিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে এই রুল দেন, যেখানে আদালত জানতে চেয়েছেন- অবসর গ্রহণের তিন বছর পার না হওয়া পর্যন্ত সামরিক-বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার বিধান কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না? (ডেইলি স্টার অনলাইন, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩)।
নির্বাচনী আইন বা 'দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার, ১৯৭২'-এর ১২(১)(চ) ধারায় বলা হয়েছে- 'সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সামরিক বাহিনী হতে পদত্যাগ কিংবা অবসর গ্রহণের তিন বছরের মধ্যে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।' এখন উচ্চ আদালত যদি এই বিধানকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং আপিল বিভাগেও এটি বহাল থাকে, তাহলে সরকারি বা সামরিক কর্মকর্তাদের পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণের পরপরই নির্বাচনে অংশগ্রহণে কোনো বাধা থাকবে না।
আমলাদের 'বুদ্ধিমত্তা' নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা ও অভিজ্ঞ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটি গল্প বলেছিলেন। একটি প্রকল্প অনুমোদন না দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন মন্ত্রী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো কারণে সেটি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন- যে ফাইলে তিনি 'নট অ্যাপ্রুভড' লিখে সই করেছেন, সেটি কী করে এখন অনুমোদন দেবেন? তাঁর দপ্তরের একজন আমলা পরামর্শ দিলেন, ফাইলে একটা 'ই' যোগ করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তাহলে 'নট অ্যাপ্রুভ' হয়ে যাবে 'নোট অ্যাপ্রুভড'। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এর নাম দিয়েছিলেন 'ই-তত্ত্ব'।
যুগে যুগে এভাবেই রাজনীতিবিদরা তাঁদের অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান ও চতুর আমলাদের সহায়তায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। যে কারণে দেখা যায়, অনেক ঝানু আমলা রাজনীতিবিদদের ওপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করেন। কখনও সেটি নিয়ন্ত্রণে পর্যবসিত হয়। অনেক আমলা অবসরে যাওয়ার পর রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং দলের ভেতরেও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন।

অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেন, যাঁরা দীর্ঘদিন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা আইনকানুন, রীতিনীতি এবং সেই সঙ্গে ফাঁকফোকর অন্যদের চেয়ে ভালো বোঝেন। ফলে সরকার পরিচালনায় তাঁদের যেমন কাজে লাগানো হয়, তেমনি অবসরের পর তাঁদের দলীয় কর্মকাণ্ডেও যুক্ত করা হয়। তাঁরা নির্বাচনী কৌশল এবং মাঠ প্রশাসনকে দিয়ে নিজের মতো করে নির্বাচন পরিচালনার কলাকৌশলও ঠিক করেন। অনেক সময় অনভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েও আমলারা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।
অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ অনেকে অবশ্য সরকার বা দলের আমলা-নির্ভরতা পছন্দ করেন না। তাঁরা অনেক সময় এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও একবার জাতীয় সংসদে সরকারের আমলা-নির্ভরতার সমালোচনা করেছিলেন। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম, ২৮ জুন ২০২১)। তাঁর সঙ্গে একই সুরে কথা বলেন একাধিক সংসদ সদস্য। কারণ করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে প্রতি জেলায় একজন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি উঠেছিল।
এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, রাজনৈতিক দল ও সরকারের আমলা-নির্ভরতার জন্য রাজনীতিবিদরা দায় এড়াতে পারেন কিনা? অদক্ষতার কারণেই আমলারা তাঁদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পাচ্ছেন- এ কথা বলা কি অন্যায় হবে? নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে আমলাতন্ত্রের অপব্যবহারও কি এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী নয়?

বাস্তবতা হলো, রাজনীতিবিদরা নিজেদের প্রয়োজনে আমলাতন্ত্রকে নিজেদের মতো করে যখন ব্যবহার করেন, তখন সেই আমলারাও সরকারের কাছ থেকে নানাবিধ বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেবেন, এটিই স্বাভাবিক। তবে এও ঠিক, যেহেতু চাকরিজীবনে তাঁরা রাজনীতির মধ্যেই থাকেন এবং অনেকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণও করেন, অতএব অবসরে যাওয়ার পরপরই তাঁরা যে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চাইবেন- সেটি অস্বাভাবিক নয়।
আরও যে প্রশ্নটি সামনে আসবে তা হলো, জাতীয় নির্বাচন মূলত টাকার খেলা। সেখানে একজন সামরিক বা বেসামরিক কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর যদি নির্বাচন করতে চান, অত টাকা তিনি কোথায় পাবেন? নাকি যাঁরা চাকরিজীবনে বেতনের বাইরেও নানাভাবে উপরি আয় করেছেন, তাঁরাই সুযোগটা নেবেন? নাকি সংশ্নিষ্ট দলই তাঁদের নির্বাচনের খরচ দেবে? অবসরে গিয়েই তাঁরা এমপি হতে চান কেন? তাঁরা চাকরিজীবনে মানুষকে যেসব সেবা দিতে পারেননি, সেগুলো দেওয়ার জন্য? কবীর সুমনের গানের ভাষায় বলতে হয়- 'প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা'।
তবে অবসরের পর তিন বছরের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না- এই বিধানটি আরপিওতে কেন রাখা হয়েছে; এর যৌক্তিকতা কী এবং কোন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এই বিধান যুক্ত করা হয়েছিল- সেটিও ভাবা দরকার।
ধারণা করা যায়, এই বিধানটি বাতিল হলে প্রশাসনে দলীয়করণ আরও বাড়বে। অসৎ ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চাভিলাষ বাড়বে। অবসরে যাওয়ার পরেই যাতে নির্বাচন করে সংসদে আসতে পারেন, সেই টার্গেট মাথায় রেখে কাজ করবেন। এখন যেমন অবসরের পর কোনো কমিশন বা প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের টার্গেট থাকে; তখন টার্গেট হবে নির্বাচন। এর ফলে বছরের পর বছর ধরে মাঠের রাজনীতিতে পোড় খাওয়া ও ত্যাগী অনেক নেতাই তাঁদের দাপটে ছিটকে পড়বেন। কারণ, আমলাদের টাকা থাকবে। একই সঙ্গে সংশ্নিষ্ট দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তাঁদের কাছে রাজনীতিবিদরা আরও বেশি গৌণ হবেন।

অনেকের মনে এ প্রশ্নটিও আছে- জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে বিষয়টি কেন আলোচনায় এলো। এই সময়ের মধ্যে অবসরে যাবেন কিংবা এক বছরের মধ্যে অবসরে গেছেন, এমন আমলাদের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য, নাকি তাঁদের তরফে এ বিষয়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ আছে?

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক