ফের ৫ শতাংশ বাড়ল বিদ্যুতের দাম। এক মাসেই দ্বিতীয়বারের মতো গ্রাহক পর্যায়ে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হলো। নতুন দাম আজ থেকে কার্যকর হচ্ছে। আগামী মাসেও বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় হতে পারে বলে জানা গেছে। এতে মূল্যস্ম্ফীতি ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন।

গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। অর্থাৎ এক মাসেই বিদ্যুতের দাম ১০.২৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিল সরকার। বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে সম্প্রতি ব্যাপক হারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা আজ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
নতুন ঘোষণা অনুসারে প্রতি ইউনিটের (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) গড় দাম ৭ টাকা ৪৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ৮৬ পয়সা হয়েছে। প্রতি ইউনিটে গড়ে ৩৭.৪ পয়সা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাহককে মার্চ মাস থেকে এই বর্ধিত মূল্যে বিল দিতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নির্বাহী ক্ষমতাবলে ফের দাম বৃদ্ধি করল সরকার। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে খুচরা বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১১০.৭২ শতাংশ।
পৃথক আরেকটি প্রজ্ঞাপনে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে গড়ে ৮.০৩ শতাংশ। এতে ইউনিটপ্রতি গড় ৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি করে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।
বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব সোমবার অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ ঋণ অনুমোদনের জন্য আইএমএফের প্রস্তাবিত সংস্কারের অংশ বলেই মনে করছেন খাত সংশ্নিষ্টরা। কারণ আন্তর্জাতিক সংস্থাটি চায় সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসুক।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে। এটা প্রতি মাসেই হবে। জ্বালানির দাম বাড়লে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। জ্বালানির মূল্য কমলে দামও কমবে। তিনি আরও বলেন, সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। ধীরে ধীরে সমন্বয়ের মাধ্যমে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে সরকার ভর্তুকি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসবে।

রেকর্ড মূল্যস্ম্ফীতির কারণে নিত্যদিনের খরচ চালাতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন যখন জেরবার, তখন বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। জিনিসপত্রের দাম অসহনীয় হয়ে উঠছে। সার্বিক মূল্যস্ম্ফীতি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, গ্যাসের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ানো হলো। বিদ্যুতের দাম আবারও ৫ শতাংশ বাড়ল। সরকার বলছে, প্রতি মাসেই দাম সমন্বয় করবে। ফলে এই মূল্যবৃদ্ধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা বলা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ী, শিল্প মালিকসহ সাধারণ মানুষ কেউই এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার একতরফা দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। আর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার হয়তো ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নিতে চাইছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষকে সুরক্ষার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে জনগণের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, ক'দিন আগে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, তখন সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখন যে হরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়নো হচ্ছে, এটা আর সহনীয় পর্যায়ে থাকছে না।
খুচরা দাম বৃদ্ধি :প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬২ পয়সা এবং ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬২ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৯৯ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ০৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়েছে।

পাইকারি বিদ্যুতের দাম :বিতরণ কোম্পানির কাছে পিডিবির বিক্রি করা পাইকারি বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। বিভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে।

খরচের বোঝা আরও বাড়ল :বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত অক্টোবরে জানিয়েছিল, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। জানুয়ারি মাসেই বিদ্যুতের দাম দুই দফা এবং গ্যাসের দাম এক দফা বৃদ্ধির পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ চাপ পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
মালিবাগের বাসিন্দা মইনুল সমকালকে বলেন, মাসের বেতনে আর চলে না। সামনে কীভাবে সংসার চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।


বিষয় : এক মাসেই দ্বিতীয়বার বাড়ল বিদ্যুতের দাম বাড়ল বিদ্যুতের দাম

মন্তব্য করুন