আদায় হওয়া রাজস্ব যথাসময়ে জমা পড়ছে না সরকারের কোষাগারে। সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিডিএমসি) পর্যবেক্ষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। কী কারণে ট্রেজারিতে সময়মতো রাজস্ব যাচ্ছে না- তা খতিয়ে দেখতে অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিডিএমসির বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৯০ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও সরকারি কোষাগারে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি সিঙ্গেল হিসাবে জমা হয়েছে মাত্র ৬৫ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। ২৫ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা যথাসময়ে ট্রেজারিতে জমা না হওয়ায় সরকারের নগদ টাকার ওপর চাপ বেড়েছে।
আদায় হওয়া রাজস্ব সরকারি কোষাগারে যথাসময়ে জমা না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সমকালকে বলেন, বর্তমানে প্রায় সব কার্যক্রম অনলাইননির্ভর হওয়ায় এনবিআর যে রাজস্ব আহরণ করে, তা সরাসরি ট্রেজারিতেই জমা হওয়ার কথা।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সমকালকে বলেন, অনেক সময় কিছু অসাধু কর্মকর্তা করদাতার সঙ্গে যোগসাজশ করে রাজস্ব আদায় হয়েছে দেখান। তবে সে টাকা ট্রেজারিতে জমা হয় না। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আদায় ও জমা করা টাকার এত বেশি ফারাক কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রকৃত চিত্র উদ্ঘাটন জরুরি। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন কারণে এ ব্যবধান এক থেকে দুই হাজার কোটি টাকা হতে পরে। তবে ২৫ হাজার কোটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সিডিএমসির সভায় জানানো হয়, মূলত রাজস্ব আহরণ কম হওয়ার পাশাপাশি সময়মতো কোষাগারে রাজস্ব জমা না হওয়ার কারণে সরকারের ব্যয়ে ঋণাত্মক প্রবণতা দেখা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হারে ঊর্ধ্বগতিতে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া ব্যয়সাপেক্ষ হওয়া এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমে যাওয়ায় নগদ টাকার ওপর চাপ বেড়েছে।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাজেট মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয় সরকার। বিল-বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়। বিল-বন্ড ইস্যু ছাড়া ওভারড্রাফট এবং 'উপায়-উপকরণ আগাম' হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ঋণ নেয় সরকার। এ দুই খাত থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত সরকার ঋণ নিতে পারে। তবে চাহিদা বেশি হওয়ায় এর পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটি।

এদিকে অস্থিতিশীল ডলারের বাজার, মূল্যস্ম্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট থাকায় ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে গেছে। সিডিএমসির সভায় জানানো হয়, আগের বছরের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের সুদ বাবদ খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অভ্যন্তরীণ ঋণে সুদ বাবদ খরচ বেড়েছে ৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। আগামীতে এটি আরও বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, রাজস্ব আহরণ ও জমার ব্যবধান এত বেশি হওয়া মানে রাজস্ব আদায়ের যে তথ্য প্রকাশ হচ্ছে, তা সঠিক নয় বা এ ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে। তাই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রযোজ্য হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) কাটার পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে তা সরকারি কোষাগারে জমা হয়। তাই রাজস্ব আদায় ও ট্রেজারিতে জমা তথ্যে কিছুটা তারতম্য হতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রতি মাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দেখাতে কোনো কোনো উৎস থেকে বাড়তি পরিসংখ্যান সরবরাহ করা হতে পারে। এ ছাড়া সমন্বিত বাজেট ও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি বা আইবাস প্লাস প্লাস সফটওয়্যারে তথ্য আপডেট হওয়ার জটিলতাও থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমবেশি হতে পারে। তবে কোনোভাবেই ২৫ হাজার কোটি টাকার তফাৎ হতে পারে না।