নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিচ্ছে দেশের পোশাক খাত। প্রায় একই অবস্থা পশ্চাৎসংযোগ শিল্প বস্ত্র খাতেও। তবে এর মধ্যেও হচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। যার বড় একটি অংশ আসছে বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকা ম্যানমেইড ফাইবারের বস্ত্র ও পোশাক উৎপাদনে। কারখানার উৎপাদন, ভবনের অবকাঠামো, জ্বালানি সরবরাহসহ নানা ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কিছু পাওয়া গেলেও এর বেশিরভাগই আমদানি করতে হচ্ছে।

কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সংযোজনের পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে বদলাতে হচ্ছে পুরোনোগুলোও। বস্ত্র ও পোশাক খাতের সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে তাই বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির চাহিদা। যে কারণে যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকদের দৃষ্টিও এখন বাংলাদেশের দিকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক রপ্তানি ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ। এতে পোশাক খাতে মেশিনারিজ বা যন্ত্রপাতির চাহিদা আগামীতে আরও বাড়বে। আবার বাড়তি পোশাক উৎপাদনে বস্ত্রের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। সেখানেও দরকার হবে যন্ত্রপাতির। সবমিলিয়ে বস্ত্র ও পোশাক খাতের মেশিনারিজের প্রধান বাজার হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।

বস্ত্রকলের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন সুতা উৎপাদনের কারখানা আছে ৫১০টি। বছরে ৩৮০ কোটি কেজি সুতা উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে তাদের। কাপড় তৈরির কারখানার সংখ্যা ২০ হাজার। কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতা বছরে ৭০০ কোটি মিটার। এর বাইরে ডেনিম কাপড় তৈরির কারখানা আছে ৪০টি, যেগুলোতে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭০ কোটি মিটার। এসব কারখানা থেকে নিট ক্যাটাগরির পোশাকের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাপড় এবং ওভেন ক্যাটাগরির পোশাকের ৫৫-৬০ শতাংশ কাপড় জোগান দেওয়া হচ্ছে। বাকি কাপড় উৎপাদন উপযোগী বিনিয়োগের চাহিদাও রয়েছে দেশে।

বস্ত্র ও পোশাক খাতের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অগ্রসর প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় মেশিনারিজ ব্যবহারে কারখানার উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান সমকালকে বলেন, ত্রিমাত্রিক মেশিনে এখন তাঁর কারখানায় কাপড় কাটা হয়। এতে একদিকে নিখুঁতভাবে কাপড় কাটা হচ্ছে। অপচয় কমছে। আবার সময় এবং মজুরি সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমছে। যদিও এ ধরনের যন্ত্রপাতির মূল্য কিছুটা বেশি। তবে চূড়ান্ত বিচারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যয় সাশ্রয়ী। এতে শ্রমিকরা বেকার হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও সে ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারণ আগে থেকেই ৩০ শতাংশ শ্রমিকের ঘাটতি আছে। এ ছাড়া অনেক কারখানায় বিনিয়োগ সম্প্রসারণে বাড়তি শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছে।

বাড়ছে যন্ত্রপাতি আমদানি: বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে বিভিন্ন মূলধনি যন্ত্রের আমদানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ। মোট ৬১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এত বেশি পরিমাণে যন্ত্রপাতি আমদানি হতে দেখা যায়নি।

গত অর্থবছরে দেশে যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ ছিল ৫২৭ কোটি ডলারের। এর মধ্যে পোশাক খাতের যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি ডলারের। আর বস্ত্র খাতে ২২ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরে মেশিনারিজের আমদানিতে ভাটা ছিল। ওই অর্থবছর মোট আমদানি মূল্য ছিল ৩৭৪ কোটি ডলার। তৈরি পোশাকের ছিল ৪৩ কোটি এবং বস্ত্র খাতে ১৮ কোটি ডলার।

২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে মোট ৪২৭ কোটি ডলার মূল্যের যন্ত্রপাতি আসে। এর মধ্যে পোশাক খাতের জন্য এসেছে ৫৩ কোটি ডলারের বেশি। বস্ত্র খাতে এর পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট ৪৬৭ কোটি ডলারের মেশিনারিজ আমদানি হয়। এর মধ্যে পোশাক খাতের যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ডলার। আর বস্ত্র খাতে ৬৬ কোটি ডলার।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৫৩ কোটি ডলারের মেশিনারিজ আমদানি হয়েছে দেশে। ওই অর্থবছর যন্ত্রপাতি আমদানিতে বস্ত্র খাত তৈরি পোশাক খাতকেও ছাড়িয়ে যায়। পোশাকের যন্ত্রপাতি আমদানি ছিল ৮০ কোটি ডলারের কম। অন্যদিকে বস্ত্র খাতে ছিল ৮১ কোটি ডলারেরও বেশি।

সরবরাহকারীদের দৃষ্টি বাংলাদেশমুখী: তৈরি পোশাকের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ চীন পোশাক খাত থেকে ক্রমেই সরে আসছে। এ কারণে দেশটিতে পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগ নেই। যন্ত্রপাতির চাহিদাও নেই দেশটিতে। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ৩০ দেশ প্রধানত বস্ত্র ও পোশাক খাতের মেশিনারিজ উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে। এসব দেশের বিপণন নেটওয়ার্কে বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয়।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্ট (ডিটিজি) মেশিনারিজ এক্সিবিশনে বিভিন্ন দেশের ১ হাজার ২০০ কোম্পানি তাদের উৎপাদিত মেশিনারিজ প্রদর্শন করেছে। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া ইতালিভিত্তিক মেশিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সানতোনির বিপণন ব্যবস্থাপক জেইনপিয়েরো সমকালকে বলেন, বস্ত্র ও পোশাক খাতের যন্ত্রপাতির বাজার হিসেবে বাংলাদেশ এখন এক নম্বর। গত দুই বছরে এ দেশে তার কোম্পানির মেশিনারিজ রপ্তানি বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশের বাজারে আরও বড় সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, রপ্তানিতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। অন্যান্য দেশের চেয়ে এখনও এ দেশের শ্রমিকদের মজুরি কম। এ কারণে অনেক ব্র্যান্ড ক্রেতারা এখন বাংলাদেশমুখী। এতগুলো সুবিধা একসঙ্গে মিলে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ মজবুত। তৈরি পোশাকের সম্ভাবনা মানেই যন্ত্রপাতির বেশি ব্যবহার। তাছাড়া প্রায় প্রতি বছর পুরোনোগুলোও বদলাতে হয়। এসব বিবেচনায় যন্ত্রপাতির বাজারে বাংলাদেশকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন তারা।

প্রদর্শনীতে ওভেন কাপড় উৎপাদনে বড় আকারের স্বয়ংক্রিয় মেশিন প্রদর্শন করছে তাইওয়ানের মেশিনারিজ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইউজিএইচ। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশক এআরজি ট্রেডিং করপোরেশন। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. শেফায়েত আলী সমকালকে বলেন, উন্নতমানের ওভেন কাপড় উৎপাদনের মেশিনটি কিছুদিন আগে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়েছে। প্রথমবারের মতো ঢাকাতেই এটি প্রদর্শন করা হয়েছে। মেশিনটি বিক্রির কথাবার্তাও চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিটিএমএ এবং তাইওয়ানভিত্তিক প্রদর্শনী প্রতিষ্ঠান ইয়র্কার ট্রেড অ্যান্ড মার্কেটিং সার্ভিস কোম্পানি যৌথভাবে ডিটিজির আয়োজন করে। জানতে চাইলে ইয়র্কার ট্রেড অ্যান্ড মার্কেটিং সার্ভিস কোম্পানির প্রেসিডেন্ট জুডি ওয়াং সমকালকে বলেন, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশ এখন খুব প্রিয় একটি নাম। পোশাক উৎপাদনের আরও বড় কেন্দ্র হতে যাচ্ছে দেশটি। নতুন নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। রপ্তানি বাজারে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে এ দেশের পণ্য। অনেক বিদেশি এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। এসব কারণে বাংলাদেশে অগ্রসর প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়বে। মেশিনারিজ উৎপাদন করে এমন কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। এবার ডিটিজি প্রদর্শনী করতে এসে সেটা খুব ভালো করেই বুঝেছেন তারা। কারণ আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার স্থায়ী সাতটি হলের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে আরও তিনটি সুবিশাল হল করা হয়েছে। তারপরও স্থান সংকুলানের অভাবে প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া যায়নি অনেক প্রতিষ্ঠানকে। আগামী আরও বড় পরিসরে প্রদর্শনী আয়োজনের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।