দেশে বর্তমানে সব ছাপিয়ে খবর হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারকদের ঘুম হারাম করছে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতিকে বলে মূল্যস্ফীতি, ইংরেজিতে  ইনফ্লেশন। ইনফ্লেশন ঘিরে উষ্মা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার যথেষ্ট কারণ থাকে।  এর একটি স্বল্পমেয়াদি সুবিধার কথা অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ফিলিপস বলেছেন এভাবে- প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি আসে, যা উৎপাদককে উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং বেকারত্ব হ্রাস করে। স্বল্প সময়ে সুবিধা দিলেও দীর্ঘকালীন যে মূল্যস্ফীতি ক্ষতিকর– তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতি নয় বরং মূল্যস্ফীতির হারটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সে হারে মানুষের আয় বাড়ছে কিনা। প্রথমটি যদি দ্বিতীয়টির আগে দৌড়ায়, মূল্যস্ফীতি হয় ভিলেন; আর আয়ের পেছনে পড়লে হয় সে হিরো। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, ৫-৭ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে প্রবৃদ্ধির ওপর আঘাতটা তত প্রবল নাও হতে পারে। কিন্তু এর ওপরে মূল্যস্ফীতির হার মানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

দুই.

দেশে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের মতো। এই হার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রক্ষেপিত হারের চেয়ে অনেক বেশি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিকূলে। বিভিন্ন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর কল্যাণের (ওয়েল বিইং) ওপরেও এর প্রভাব সুখদায়ক নয়। স্বীকার করতেই হবে, এই মূল্যস্ফীতির পেছনে কাজ করেছে প্রথমত কভিড, পরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অর্থনীতির ভাষায় কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন। উভয় ক্ষেত্রে সাপ্লাই চেন বিঘ্ন হওয়া জ্বলন্ত উনুনে হাওয়া দিয়েছে। যা-ই হোক, দরিদ্র শ্রেণির ওপর  মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব প্রাধান্য পাওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, তারা আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ খরচ করে খাদ্য ক্রয়ে। তার মধ্যে ৪০ ভাগ চলে যায় চাল ক্রয়ে। মূল্যস্ফীতি যখন বাড়তে থাকে তখন শ্রমিকের মজুরি শ্রমিকের কাছ থেকে মুনাফার দিকে ধাবিত হয় বলে আয় বৈষম্য বাড়ে। কারণ, এটা ধনীর চেয়ে গরিবকে আঘাত করে বেশি।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সূত্রে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবনতি ঘটে– এমন ব্যাখ্যা নিতান্তই হালকা, সরলরৈখিক। বলা যেতে পারে, তা জলের ওপর ওড়াউড়ি কিন্তু জল স্পর্শ করা নয়। মূল্যস্ফীতির অগোচরে থাকা প্রভাবটা আলোতে আসে যখন আমরা গরিবের পুষ্টির কথা ভাবি। বাংলাদেশে বর্তমানে চার সদস্যের একটা পরিবারে সুষম খাদ্য সরবরাহে প্রতি মাসে প্রয়োজন প্রায় ১৯ হাজার টাকা। দিনমজুর, রিকশাচালক, চর্মকার কিংবা গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত মানুষসহ যে কোনো নিম্ন আয়ের মানুষ এখন প্রতিদিন যে আয় করছে, তাতে এই পুষ্টি জোগানো প্রায় অসম্ভব।

তিন.

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলছেন, দুর্ভিক্ষে যত মানুষ মারা যায় তার চেয়ে বেশি মারা যায় কম পুষ্টির কারণে। অপুষ্টির কারণে অনেকে খুবই কষ্টকর জীবন যাপন করে। অপুষ্টির শিকার মা যে সন্তান জন্ম দেন, সে হয় খর্বকায় কিংবা রোগা। ভয়ংকর উত্তরাধিকার হিসেবে অপুষ্টি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। এসব শিশু পরবর্তী সময়ে অপুষ্টিজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে না। তারা প্রায়শ অসুস্থ হয়ে পড়ে; ভালোভাবে শিখতে পারে না এবং বয়ঃপ্রাপ্তিতে তারা থাকে কম উৎপাদনশীল। সুতরাং, একটা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র বা দারিদ্র্য-জাল তৈরি হতে পারে যেখানে কম পুষ্টির কারণে দুর্বল স্বাস্থ্য, কম মজুরি এবং কম পুষ্টি দেখা দেয়।

চার.

যদি বলি মৃত্যু তিন ধরনের– স্বাভাবিক মৃত্যু, অপঘাতে মৃত্যু ও খাদ্যে মৃত্যু; তাহলে বোধ করি খুব একটা ভুল বলা হবে না। প্রথমটি বিধাতার অমোঘ বিধান, তাই অবধারিত। এর হাত থেকে রেহাই নেই, তা সে যত সম্পদশালীই হোক। কবির কথায়– মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে কিংবা হুমায়ূন আহমেদের দুশ্চিন্তা– রূপময় পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে। এসবই আফসোস ও আকাঙ্ক্ষা। রূঢ় বাস্তব হচ্ছে মৃত্যু। যা-ই হোক, দ্বিতীয় ধারার মৃত্যুটি অপ্রত্যাশিতভাবে জীবন হারানো, যেমন ট্রেনে কাটা পড়ে, বোমার আঘাতে, বজ্রপাতে কিংবা অন্য কোনো দুর্যোগে। এ ধরনের মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত, অনেকটা দৈবিক। তৃতীয়টি অর্থাৎ খাদ্যের অভাবে মৃত্যু অনেকটা শেষ নিঃশ্বাসের পথে শেষ ধাপ, বেঁচে থেকে মরার মতো। কচু-ঘেচুর মতো খাবার পেটে যায় বটে, তবে পুষ্টির অভাবে হাড্ডিসার ও খর্বকায় শরীর নিয়ে মজুরিতে কাজ পাওয়া যায় না। কাজ পেলেও মজুরি অত্যন্ত কম, যা দিয়ে পুষ্টিকর খাবার কেনা যায় না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জীবন চলে, নিভু নিভু বাতি। অপুষ্টিজনিত মৃত্যু অপমৃত্যু, যা এক ধরনের গণহত্যা। সব মিলিয়ে বলা চলে, একদিকে খাদ্যের অভাব, অন্যদিকে খাবারের স্বভাব– দুটিই ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক এবং অপুষ্টির প্রধান বাহক।

পাঁচ.

বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ভারসাম্য আসে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়, যাতে ভোক্তা তার উদ্বৃত্ত ধরে রাখতে পারে। এখানে উৎপাদকরা উদ্বৃত্ত ভোক্তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় নানা ফাঁকফোকরে। এখানে মূল্যবৃদ্ধির পেছনে মার্কেট ম্যানিপুলেশন কাজ করতে পারে। তাই কঠোর নজরদারি দরকার। দরকার আরও চাহিদা সংকোচন নীতি, কৃষিতে ভর্তুকি এবং বিলাসী ব্যয় কমানো। এরই মধ্যে সরকার এ সংক্রান্ত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো যথেষ্ট না হলেও অত্যন্ত কাম্য ছিল।

মূল্যস্ফীতি ঘটলে সুদের হার বৃদ্ধির প্রথাগত নীতি-সুপারিশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কেন গড়িমসি করছে, তা বোধগম্য নয়। শুনলাম, শিল্পপতিদের সংগঠনের সভাপতি যুক্তি দিচ্ছেন এই বলে– সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। তা ঠিক তবে আংশিক কারণ বিগত বছরগুলোতে সুদের হার কমলেও ব্যক্তি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো সুখবর নেই। দরকার ব্যবসাবান্ধব নীতি, যেখানে বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। এর বিপরীতে দেশে চলছে ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি, বিশেষ করে স্বজন-তোষণ পুঁজিবাদ। অতএব সবার স্বার্থে সুদের হার বাড়ানো উচিত অন্তত আপাতত। আরও দু-একটা কথা না বললেই নয়। প্রথমত, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির মুখে মানুষের হাতে যেন উপার্জনক্ষম কাজ থাকে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, গরিব শ্রেণির জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ভর্তুকি সমেত খাদ্যের জোগান দিতে হবে। তৃতীয়ত, অপুষ্টি হ্রাসের জন্য প্রতিশ্রুতি নিয়ে সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। চতুর্থত, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য পরিবেশ তৈরির জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পঞ্চমত, অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া, পুষ্টিকর খাবার যেমন ডাল জাতীয় শস্য, ফলমূল ও সবজিবিষয়ক গবেষণা এবং উন্নয়ন বিনিয়োগ, বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে পুষ্টি ও খাদ্যসংক্রান্ত জ্ঞান, আচরণগত পরিবর্তনে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ খাতের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়ও প্রয়োজন।

পাদটীকা

স্ত্রী: মূল্যস্ফীতি কথাটার মানে কী?

স্বামী: যখন আমাদের বিয়ে হয়, তখন তুমি ছিলে ৩৬-২৪-২৪। এখন তুমি ৪২-৪২-৪২। তোমাকে দেখায় বড় কিন্তু কর্মক্ষমতা কম। মূল্যস্ফীতি ঘটলে টাকারও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়– বস্তাভর্তি টাকার বিনিময়ে পকেটভর্তি মাল– এবং এর নাম ইনফ্লেশন।

অধ্যাপক আব্দুল বায়েস : প্রাক্তন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়