সোনালি আঁশ পাটের সুদিন ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরির কথা শোনা যায় প্রায়ই। তবে ওই ‘শোনা’ পর্যন্তই। সুদিন তো দূরের কথা, এ খাতের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে রপ্তানি আয়ে পাটের অবদান ছিল ৯৩ শতাংশ। সেই চিত্র এখন পুরোটাই বিপরীত। সবশেষ গেল জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের সাত মাসের রপ্তানিতে পাটের অবদান মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অথচ পাটের প্রায় শতভাগ মূল্য সংযোজন সুবিধা রয়েছে। কাঁচা পাট থেকে পণ্য উৎপাদনে বলতে গেলে কিছুই আমদানি করতে হয় না।

বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী, দেশে মানসম্পন্ন পাটপণ্য উৎপাদনে মনোযোগ না দেওয়া এ শিল্পের প্রধান দুর্বলতা। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও বিপণন কৌশলের অভাবে বিশ্ববাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলানো যাচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের প্রধান বাজার। গত ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের পাটপণ্য আমদানিতে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে রেখেছে দেশটি, যা রপ্তানি কমে যাওয়ার মূল কারণ।

এ অবস্থায় আজ সোমবার পালিত হচ্ছে জাতীয় পাট দিবস। এই উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, সোনালি আঁশখ্যাত পাটের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। দেশি সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে মানানসই পাট ও পাটজাতপণ্য দেশে-বিদেশে পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে।

পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত শ্রমঘন পাট খাত দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

তিন বছরেও চালু হয়নি বন্ধ সরকারি পাটকল: ক্রমাগত লোকসানের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৭টি পাটকলের সব এখন বন্ধ। ২০২০ সালের ১ জুলাই ২৫টি পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। দুটি পাটকল বন্ধ হয় আরও আগে। বন্ধ হওয়ার আগে ২৫টি পাটকলে ২৬ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে তাঁদের সব পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। বন্ধ পাটকলগুলো দ্রুততম সময়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) কিংবা শতভাগ বেসরকারি মালিকানায় চালুর সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। গত প্রায় তিন বছরেও কোনো পাটকল চালু করা সম্ভব হয়নি। মাত্র দুটি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এখনও উৎপাদন শুরু হয়নি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বন্ধ থাকা পাটকল উৎপাদনে এলে এ খাতে গতি আসবে। কৃষক ও উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন। রপ্তানি বাণিজ্যের পালে হাওয়া লাগবে। সমকালকে তিনি আরও বলেন, নিয়োগ, বেতন কাঠামো নির্ধারণসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের শতভাগ স্বাধীনতা থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠান মনোনয়নের প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান রাহাত আনোয়ার বলেন, ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও ৯টি পাটকল। দ্রুতই এ কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন।

কাঁচা পাটের দাম নিয়ে কারসাজি: পাটের বিভিন্ন সংকটের সঙ্গে কাঁচা পাটের মূল্য নিয়ে কারসাজি অন্যতম। এ ছাড়া পাটের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন শিল্পবর্জ্যে তৈরি তুলার সুতা এখন বেশি ব্যবহার হচ্ছে। বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সভাপতি আবুল হোসেন জানান, কারসাজি করে অবৈধ মজুতের মাধ্যমে পাটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। আগেই কৃষকের কাছ থেকে কম দামে পাট কিনে নেওয়া হয়। এবার মণপ্রতি সাত হাজার টাকায় উঠে যায় পাটের দাম। এতে পাটপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাচ্ছে না।

কমেছে রপ্তানি: কাঁচা পাটের সংকট এবং অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের পর থেকে সব ধরনের পাটপণ্যের রপ্তানি কমেই চলেছে। গেল ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের আট মাসে পাট ও পণ্য রপ্তানি কম হয়েছে ২৪ শতাংশ। মাত্র ৬১ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি হয় এ সময়, যা রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ শতাংশ কম। পাটের সুতা এ খাতের সবচেয়ে বড় পণ্য, যার রপ্তানি কমেছে সবচেয়ে বেশি ৩৪ শতাংশ।

অ্যান্টিডাম্পিং শুল্কের কারণে বন্ধ হচ্ছে কারখানা: বাংলাদেশের পাটপণ্য আমদানিতে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়েছে ভারত। দ্বিতীয় এ মেয়াদে গত জানুয়ারিতে টনপ্রতি সাড়ে ৬ ডলার থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়।

বিজেএমএ সভাপতি এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশের পাটপণ্যের ৬০ শতাংশের বাজার ভারতে। প্রথম মেয়াদে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের কারণে বাজার হারিয়ে ৭০টি পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রায় ২০০ দেশে পাটপণ্য রপ্তানি করেন তাঁরা। কোনো দেশ ভারতের মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

‘পাট শিল্পের অবদান, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ প্রতিপাদ্যে এবারের দিবসে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। রোববার মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী জানান, দিবসের মূল অনুষ্ঠান হবে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এতে প্রধান অতিথি থাকবেন। মতিঝিলের করিম চেম্বারে বহুমুখী পাটপণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র উদ্বোধন করা হবে। শিল্পকলা একাডেমিতে হবে বহুমুখী পাটপণ্যের মেলা।