ইউরোপ ও আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেখানকার ক্রেতারা ভোগ্যপণ্যে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন। এতে কমে আসছে তৈরি পোশাকের চাহিদা। এ কারণে রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। মূল্যহ্রাস ও মূল্যছাড়ের পোশাকের প্রতি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে পোশাক খাতে সংকট তৈরি হয়েছে।

শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। সম্প্রতি ব্র্যান্ড ক্রেতাদের রপ্তানি আদেশের কৌশলে পরিবর্তন আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্রেতারা একসঙ্গে রপ্তানি আদেশ না দিয়ে ছোট ছোট স্লটে বা পরিমাণে কম রপ্তানি আদেশ দিচ্ছে। এ কারণে কারখানা পর্যায়ে উৎপাদন পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে অনুকূল নীতি-সহায়তার প্রয়োজন। পোশাক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে রপ্তানি পরিস্থিতি, রপ্তানি আদেশের প্রবণতা, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে মানবাধিকার ও ডিউ ডিলিজেন্স প্রটোকল অনুসরণের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়। বিজিএমইএর সহসভাপতি নাসির উদ্দিনসহ অন্য নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত নকল পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানির প্রসঙ্গে ফারুক হাসান বলেন, বিজিএমইএর কোনো সদস্য কারখানা এ কর্মকাণ্ডে জড়িত নয়। অভিযোগের পর যাচাইয়ে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানান তিনি। ফারুক হাসান বলেন, নকল পণ্য উৎপাদন ও পাচারের দায় নেবে না বিজিএমইএ। এ বিষয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জনান তিনি।

ফারুক হাসান জানান, অভিযোগ এড়াতে পণ্যের গায়ে সাধারণ লেবেলিংয়ের পরিবর্তে কিউ আর কোডের মাধ্যমে ডিজিটাল লেবেলিং চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে লেবেলিং হলে পণ্যের স্বচ্ছতা এবং উৎস দেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। নকল পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি নিয়ে আর কোনো শঙ্কা থাকবে না। এতে উৎপাদন খরচ এবং কার্বন নিঃসরণ কমবে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) সঙ্গে বিজিএমইএর আলোচনা হয়েছে।

তিন কারণে রপ্তানি বৃদ্ধি: প্রতিকূলতার মধ্যেও তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, পরিমাণে কম পণ্য রপ্তানি করেও বেশি মূল্য পাওয়া গেছে। এর পেছনে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেন ফারুক হাসান। প্রথম জ্বালানি তেল ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, যার প্রভাব পোশাকের মূল্যের ওপর পড়েছে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চ মূল্যের পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি বেড়েছে। বেশ কিছু কারখানা উচ্চ মূল্যের জ্যাকেট, অ্যাকটিভ ওয়্যার ও স্যুট-ব্লেজারে উৎপাদন করছে। এর ফলে পোশাকে পিসপ্রতি বেশি মূল্য পাওয়া গেছে। মূল্যবৃদ্ধির তৃতীয় কারণ হিসেবে অপ্রচলিত বাজারের কথা উল্লেখ করেন তিনি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রণোদনা দেওয়ার পর এই শ্রেণির বাজারগুলোতে রপ্তানি বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে।

সব পোশাকে ‘বাংলাদেশের তৈরি’ লেবেল: দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হিসেবে বাংলা ভাষা, দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে আগামী বছর থেকে রপ্তানিযোগ্য সব পোশাকের গায়ে ‘বাংলাদেশের তৈরি’ লেবেল থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি। এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো একটি কোম্পানি তাদের পোশাকের গায়ে এই লেবেল যুক্ত করে রপ্তানি করেছে বলে জানান তিনি। এ ব্যাপারে বৈশ্বিক ক্রেতাদের সহযোগিতা চান ফারুক হাসান। পোশাক ছাড়াও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি এবং স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত পণ্যেও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় বাংলাদেশের তৈরি লেবেল ব্যবহারে উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভোক্তাদের আচরণের পরিবর্তন এসেছে। সার্কুলার ফ্যাশন এবং রিসাইকেল্ড পণ্যের ব্যাপারে ভোক্তা বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এ ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থায় সংযুক্ত হয়েছেন। প্রতিবছর বস্ত্র ও পোশাক খাতে বর্জ্য হিসেবে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ টন ঝুট কাপড় পাওয়া যায়। রিসাইকেল প্রক্রিয়ায় এসব ঝুট থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পোশাক উৎপাদন করা সম্ভব। এ-সংক্রান্ত পণ্য এবং সেবাকে শুল্ক ও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানান বিজিএমইএ সভাপতি।