চট্টগ্রামকে বলা হয় বাণিজ্যিক রাজধানী। বলা হয় বন্দরনগরীও। এখানেই আছে দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জ। শতবর্ষী সেই মোকাম ও ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর রিজিওনাল এডিটর– সারোয়ার সুমন

কর্ণফুলীতে নিয়মিত ড্রেজিং না হওয়ায় জমেছে পলির পাহাড়। পলির কারণে জোয়ারের পানিতে প্রতিবছর পানি ওঠে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন গুদামে। বর্ষা এলেই ক্ষতির মুখে পড়েন মোকামের ব্যবসায়ীরা। তাই বনেদি ব্যবসায়ীরা ছাড়ছেন দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জ। এখানে লেনদেনও কমে এসেছে অর্ধেকে। রমজানকে ঘিরে  জমজমাট থাকার চিরপরিচিত  দৃশ্যও যেন অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। পলি জমে এই মোকামসংলগ্ন চাক্তাই খালে বন্ধ হয়ে গেছে ২৪টি পুরোনো নৌঘাটও। এ ছাড়া অপরিকল্পিত স্লুইসগেট খাতুনগঞ্জের সংকট আরও বাড়িয়েছে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা নিয়ে হয়েছে গবেষণা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সহযোগিতায় সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) যৌথ উদ্যোগে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।  গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের বড় পাইকারি এ বাণিজ্যকেন্দ্রে এক দশকে জলাবদ্ধতার  কারণে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরাসরি ক্ষতি হয়েছে পাঁচ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। ২০২১ সালে প্রকাশিত গবেষণায় সমস্যা সমাধানে কিছু সুপারিশ করা হয়। গবেষণার তথ্য তুলে দেওয়া হয় সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর হাতেও।

গবেষণাটি পরিচালনা করেন ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিবেশ অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রিয়াজ আকতার মল্লিক এবং আরবান মেট্রোলজিস্ট আবু তৈয়ব মোহাম্মদ শাহজাহান। গবেষণার সমন্বয়কারী ছিলেন সুমাইয়া মামুন। গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন বেসরকারি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু তৈয়ব মোহাম্মদ শাহজাহান। গবেষকরা আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণের জন্য পাঁচ ধরনের হিসাব বিবেচনায় এনেছেন। সেগুলো হলো– জলাবদ্ধতার সময় পণ্যের ক্ষতির পরিমাণ, অবকাঠামো ও সম্পদের ক্ষতি, অবকাঠামো খাতে বাড়তি বিনিয়োগ, পরিবহনসেবা ও শ্রম খাতে কর্মঘণ্টা নষ্ট এবং বাড়তি পরিচালন ব্যয়। সরাসরি ছাড়াও পরোক্ষ ক্ষতির কথাও তুলে ধরা হয় গবেষণায়। অবশ্য পরোক্ষ ক্ষতির আর্থিক মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

বন্ধ হয়ে গেছে ২৪টি নৌঘাট

বছর কয়েক আগেও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে সন্দ্বীপে নৌপথে পণ্য পরিবহন হতো চাক্তাই খালের মিলিটারি পুল দিয়ে। পলি জমায় ঘাট স্থানান্তরিত হয় খান সাহেবের পুলে। সেটিও বন্ধ হয়ে পণ্য ওঠানামা হচ্ছে খালের মুখে থাকা ফজল করিমের ঘাটে। সন্দ্বীপের পাশাপাশি কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লাসহ চট্টগ্রামের আশপাশের ১১টি জেলার পণ্যও এখন ওঠানামা করতে হচ্ছে এই একটি মাত্র ঘাট দিয়ে। কারণ পলি জমায় এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে চাক্তাই খালে থাকা সিরাজ মিয়ার ঘাট, বাদশা মিয়ার ঘাট, ওয়াহিদ আলী মাঝির ঘাট, অছি মিয়ার ঘাট, পাক্কা পোল ঘাট, লাঠির পোল ঘাট, মেঘনা মিল ঘাট, ফুলতলাসহ ২৪টি ঘাট। সবেধন নীলমণি হয়ে থাকা ফজল করিমের ঘাটটিও সচল থাকছে শুধু জোয়ারের সময়।

জোয়ার ছাড়া জাহাজ ঢোকে না চট্টগ্রাম বন্দরে

জোয়ারের ওপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরে এখন কনটেইনারবাহী জাহাজ ঢুকতে পারে দিনের বেলা শুধু একবার। আবার ১০ মিটারের অধিক কোনো জাহাজ জোয়ার এলেও ঢুকতে পারে না বন্দরে। বহির্নোঙরে কিছু পণ্য খালাস করেই বন্দরে নোঙর করতে হচ্ছে বেশির ভাগ জাহাজকে। এ কারণে বাড়ছে পণ্যের ব্যয়, বাড়ছে জাহাজের দৈনন্দিনের নির্ধারিত খরচও। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বে-টার্মিনাল নামে বিকল্প আরেকটি টার্মিনাল করার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। নদীর মোহনায় এ টার্মিনাল হলে কর্ণফুলীতে পলি জমার প্রভাব এড়াতে পারবে। নতুন এ টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তাই ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজও অনায়াসে নোঙর করতে পারবে এ টার্মিনালে। এখানে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে পারবে পাঁচ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ। চট্টগ্রাম বন্দর এভাবে বিকল্প ঠিক করলেও ভালো কোনো সমাধান বের হয়নি দেশের প্রধান পাইকারি মোকামের জন্য। খাতুনগঞ্জে তাই ব্যবসা কমছে প্রতিবছর।

জোয়ার-ভাটায় নির্ভর খাতুনগঞ্জ

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদ জানান, নদীতে ভাটা পড়লে কিংবা বেশি বৃষ্টি হলেও এখন স্থবির হয়ে পড়ে খাতুনগঞ্জ। কারণ ভারী বর্ষণ কিংবা অতি জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় প্রধান  পাইকারি মোকামের অনেক গুদাম। আড়তে থাকা পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডাল, শুকনো মরিচ, হলুদ, আদা, চালসহ অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের ৮০ শতাংশই পানিতে ডুবেছে গত বছরও। বনেদি ব্যবসায়ীরা বিরক্ত হয়ে ছাড়ছেন খাতুনগঞ্জ। আর এখানকার অনেক শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে বিকল্প পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। খাতুনগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর জামাল হোসেন বলেন, ‘নগরের জলাবদ্ধতা দূর করতে গিয়ে যেন গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে চাক্তাই খালকে। এই খালের মুখে দেওয়া হয়েছে স্লুইসগেট। এ সিদ্ধান্ত পাইকারি মোকামের সমস্যা আরও বাড়িয়েছে।’ খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মিয়া মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘জোয়ার না এলে নিথর হয়ে পড়ে থাকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বাণিজ্য। ক্রমেই পলি জমে অনেক ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন চাক্তাই খালের মুখের দু-তিনটি ঘাটে সীমিত আকারে চলছে পণ্য ওঠানামার কাজ। আবার অতি বৃষ্টি হলে কিংবা বেশি জোয়ার এলে খাতুনগঞ্জের বাদশা মার্কেট, ইলিয়াচ মার্কেট, চান্দমিয়া গলি, হামিদুল্লাহ মার্কেট, সোনামিয়া মার্কেট, নবী মার্কেটসহ অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায় এখন।

যে কারণে ভরাট হচ্ছে খাল

খালের মোহনায় সেমিপাকা ঘর করে ভাড়া দিয়েছেন কসাই আক্তার। একই স্থানে বেশ কিছু ঘর করে ভাড়া দিয়েছেন জাহাঙ্গীর মেম্বার। এ ছাড়া রয়েছে আব্দুল মালেকের সেমিপাকা কলোনিও। খালের মোহনা থেকে একটু সামনে এগোলেই চামড়া গুদাম। এই এলাকায় খালের ওপর উঠেছে ডেভেলপার কোম্পানি ওপিডিএলের চার তলা ভবন ‘ওমর আলী হাইটস’। এ ভবনের একাংশ খালের ওপর। নতুন চাক্তাই বাদশা মিয়া ঘাটে খালের ওপর ভবন করেছেন রমিজ মিয়া ও আবুল হোসেন। একই এলাকার ফায়ার সার্ভিসের সামনে আবুল কালাম সওদাগর ৬০ শতক খালের ওপর গড়ে তুলেছেন লাকড়ির গুদাম। এর কিছু অংশ তিনি নিজে ব্যবহার করে বাকিটা দিয়েছেন ভাড়া। একই খালের মধ্যম চাক্তাই অংশে রয়েছে মক্কা সেন্টারের তিন তলা ভবন। এর ২০০ গজের মধ্যে রয়েছে জাহিদ মার্কেট। এভাবে বেদখল হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে চাক্তাই খালের পানির প্রবাহ। তাই বেশি বৃষ্টি হলেই জোয়ারের পানি একাকার হয়ে ভাসিয়ে দেয় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের শত শত গুদামের পণ্য। এসব স্থাপনার বেশ কয়েকটি উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন। কিন্তু ক’দিন পর আবারও দখল হয়ে যায় চাক্তাই খালের দুই পাড়।

প্রতারণাও ক্ষতি করছে খাতুনগঞ্জের

শত বছরের পুরোনো ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এক সময় এখানে বিশ্বাসের ওপর ভর করে চলত শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। মুখের কথায় একজন অন্যজনের সঙ্গে লেনদেন করতেন কোটি কোটি টাকা। কিন্তু একের পর এক প্রতারণার ঘটনার কারণে ব্যবসায়ীদের সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে এখানে। টাকা মেরে পালিয়ে গেছেন অর্ধশত অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই ছেড়ে গেছেন এই পাইকারি মোকাম। আবার ব্যাংক ঋণ জটিলতায় পাইকারি মোকাম ছেড়েছে ইলিয়াছ ব্রাদার্স, নুরজাহান গ্রুপসহ এক ডজনেরও বেশি বড় প্রতিষ্ঠান।

ফাইলবন্দি ১৭ দফা সুপারিশ

প্রধান পাইকারি মোকামে জলাবদ্ধতার  সমস্যা দূর করতে গবেষণায় ছিল ১৭ দফা সুপারিশ। চাক্তাই খাল পরিকল্পিত উপায়ে খননের সুপারিশ ছিল। যানজট নিরসন করতে বহুমুখী পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করেন গবেষকরা। জলাধার ও সবুজ এলাকা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।  ‘ইউ ম্যাপ’ মডেল ব্যবহার করে খাতুনগঞ্জ এলাকায় জলাবদ্ধতা কমানোর পরামর্শ দেন মেট্রোলজিস্ট আবু তৈয়ব মোহাম্মদ শাহজাহান। গবেষণা প্রকাশের সময় তিনি বলেন, খাতুনগঞ্জে বর্তমানে ৫৫ দশমিক ৯০ শতাংশ এলাকাজুড়ে ভবন রয়েছে। খাল, নালাসহ জলাধার রয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। অথচ এই এলাকায় জলাধার বাড়ানো গেলে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে যাবে। গবেষক রিয়াজ আকতার মল্লিক বলেন, দিনে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলেই চাক্তাই খালসহ আশপাশের খালে পানির উচ্চতা ৪ দশমিক ১ মিটার বেড়ে যায়। এতে প্রধান সড়কে ১ মিটারের উঁচু পানি জমে যায়। জোয়ার হলে তা আরও বাড়ে। এ সমস্যা দ্রুত সমাধান করা দরকার। তা না হলে ক্ষতির অঙ্ক বাড়বে প্রতিবছর।