- অর্থনীতি
- সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্নে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে
সাক্ষাৎকার
সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্নে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে

মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল মানবাধিকারবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। এর আগে ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নীতিগত বিরোধের কারণে পদত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সংগীত শিক্ষক হিসেবে। পরে জাতিসংঘে আইন পরামর্শক হিসেবেও বিদেশে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুলতানা কামালের জন্ম ১৯৫০ সালে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন
সমকাল: আমরা জানি, আপনি এখন বিলেতে অবস্থান করছেন। দৌহিত্রদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে আপনার অসাধারণ ভূমিকা সম্পর্কে পরিবারের উত্তর-প্রজন্ম কতটা জানে?
সুলতানা কামাল: প্রথমেই বাংলাদেশের ৫২তম স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই সবাইকে। আমি এখন যে বয়সে পৌঁছেছি, বৃহত্তর পরিবারের উত্তর-প্রজন্ম তিন স্তরে বিস্তৃত হয়েছে। তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের ভূমিকার কথা জানে, উপলব্ধি করতে পারে। আমার নিজের দৌহিত্ররা এখনও একেবারেই শিশু। একজন মাত্র তিন বছর পার করেছে, অন্যজনের এখনও এক বছর হতে বাকি। তবে মুক্তিযুদ্ধ সেই সময়ের, কিছু কুলাঙ্গার ব্যতীত, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণে যেমন করে আলোড়ন তুলেছিল, আমাদের পুরো পরিবারে তার ঢেউ লেগেছিল। তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হৃদয়ের গভীরেই জায়গা পেয়েছে। সেখানে আমারও একটা অবস্থান আছে।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের আগেও স্বাধিকার আন্দোলনের সময় থেকেই আপনি ও আপনার পরিবার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।
সুলতানা কামাল: মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। সেই আটচল্লিশ থেকে শুরু করে এ দেশের মানুষ নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়েছে। নিজের ভাষায় কথা বলা, নিজের পরিচয়ে সসম্মানে বাঁচতে চাওয়া, নারী-পুরুষ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মানুষের সমঅধিকার ও মর্যাদা– আমাদের সব আন্দোলনের মূলে তো সেই দাবিই ঘুরেফিরে এসেছে। আমরা যদি একে একে ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন শিক্ষার আন্দোলন, নারী অধিকার ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলন, ছয় দফা ও এগারো দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সব শেষে সত্তরের নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ নির্মাণের ধাপগুলো আমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা দেবে। পারিবারিক কারণে প্রায় প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থেকেছি।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা প্রথম কখন ভেবেছিলেন?
সুলতানা কামাল: মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়াটা আমার জন্য বিশেষ ভাবনা-চিন্তার ব্যাপার ছিল না; বরং অবধারিত ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হবে আর আমি বা আমার পরিবারের সদস্যদের তাতে যুক্ত না হওয়াটা অকল্পনীয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সাতষট্টি থেকে একাত্তর। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনেরও আমি ঘনিষ্ঠ অংশী। সেই পথ ধরেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। তখনকার পরিস্থিতি একটি লক্ষ্যেই ধাবিত হয়েছে– সেটি স্বাধীনতা।
সমকাল: ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির চারটি অক্ষর নিয়ে বাংলা চারু ও কারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদের মিছিলের একটি ছবি অনলাইনে দেখা যায়। ছবিটি আমরা আপনার সাক্ষাৎকারের সঙ্গে প্রকাশ করছি। এর পেছনের গল্পটি বলুন।
সুলতানা কামাল: ছবিটি খুব সম্ভবত মার্চের ১৭ তারিখের। মিছিলের পুরোভাগে এখানে যে চারজনের বুকে স্বাধীনতা শব্দটা ধরা আছে, তার প্রথমজন আমার ছোট বোন সাঈদা, দ্বিতীয়জন পিনু এবং তৃতীয়জন শোভা। এরা তিনজনই তখন চারুকলা কলেজের ছাত্র। চতুর্থজন আমি। আমি তখন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ৭ মার্চেই প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, স্বাধীনতা শব্দটি তখন থেকে আমাদের হলো।
সমকাল: স্বাধীনতা আসার আগে এসেছিল ২৫ মার্চের ভয়াবহ কালরাত্রি আর দিনের পর দিন গণহত্যা। ওই সময় কীভাবে কেটেছে আপনাদের?
সুলতানা কামাল: বিশ্বাসঘাতকতা আর নৃশংসতার সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করা যে কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসাধ্য। প্রতিদিন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, চেনা-অচেনা লোকের নিষ্ঠুরভাবে নিহত হওয়া অথবা হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ। যন্ত্রণা আর কষ্টের সঙ্গে অপমানিত হওয়ার গ্লানি। মানুষের শুধু প্রাণটুকু বাঁচানোর কী আর্তি! দলে দলে মানুষ এখান থেকে ওখানে ছুটে চলেছে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। আশপাশ থেকে ভয়ার্ত স্বরে কোরআন শরিফ পাঠের শব্দ। মনে হয়েছে, এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার। জানা গেল মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিবাহিনী গঠনের কথা। যেহেতু আমার মা সুফিয়া কামাল ছিলেন অনেকের অকৃত্রিম ভরসার স্থল, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটতে সময় লাগল না। দেশের ভেতরেই সংবাদ আদান-প্রদান, একের সঙ্গে অপরের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আশ্রয় দেওয়া, চাঁদা তুলে তাঁদের পথখরচা আর দিন যাপনের সুবিধা করে দেওয়া– এই কাজে নিযুক্ত করলাম নিজেদের।
সমকাল: ঢাকা থেকে সীমান্ত পার হলেন কীভাবে? বিশেষ কোনো ঘটনা রয়েছে?
সুলতানা কামাল: হ্যাঁ, এমন এক ঘটনা ঘটল, যার পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। আমাদের সামনের বাড়িতে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ পরিবারসহ থাকতেন। আমরা তাঁকে সীমান্ত পার হতে সহযোগিতা করেছিলাম। বিষয়টি জানাজানি হলে আমাদের এবং আমাদের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তাই তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের দুই বোনকে বাড়ি ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। বাড়ি থেকে যখন বেরোলাম কোথায় যাচ্ছি, কী আছে সীমান্তের ওপারে– কিছুই জানি না। একটিই পণ, মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছি। এই প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া। সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্ধু এবং হামিদুল্লাহ ভাইয়ের স্ত্রী ও তাঁদের তিন শিশুসন্তান। মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ চৌধুরী আর মাহমুদুর রহমান বেনু আমাদের সীমান্ত পার করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অপর পাড়ে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (পরবর্তী সময়ে মেজর) ডা. আকতার আহমেদ। তিনি আগরতলার সোনামুড়া বলে একটি জায়গায় ভারত সরকারের বন বিভাগের বদান্যতায় একটি ঘরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্র পরিচালনা করছিলেন। পূর্বপরিচিতির সুবাদে আমরা দুই বোন তাঁর সঙ্গে কাজে যুক্ত হলাম। স্বেচ্ছাসেবী নার্স হিসেবে। ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ (তখন মেজর খালেদ) আমাদের আকতার ভাইর সঙ্গে কাজ করার অনুমোদন দিলেন। আমাদের নাম নথিভুক্ত করা হলে মুক্তিবাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেওয়া পাকাপোক্ত হলো।
সমকাল: সেই চিকিৎসাকেন্দ্রই তো পরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে রূপ নেয়। সেখানকার বিশেষ কোনো স্মৃতি এখনও নাড়া দেয়?
সুলতানা কামাল: অনেক স্মৃতিই ঘুরেফিরে মনকে নাড়া দিয়ে যায়। একেবারে কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই হাতে-কলমে কাজ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত মুক্তিসেনাদের অপারেশনে ডাক্তারদের সাহায্য করা, তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা শোনা। ক্রমে সেখানে স্বেচ্ছাসেবী সেবিকার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ জনে এবং আর বেশ কয়েকজন ডাক্তার এসে যোগ দেন। মনে পড়ে, এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা অসুস্থ থাকাতে যুদ্ধে যেতে পারেননি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে, সে জন্য তাঁর কী যে কান্না! বোনের আদরে তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়া। মনে আছে রুমী এসেছিল দেখা করতে ঢাকায় ঢোকার আগে। সেই ওকে শেষ দেখা।
সমকাল: যে স্বপ্ন সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তা কতটা পূরণ হয়েছে? এত আত্মত্যাগ, স্বজন বিয়োগ, নারী নির্যাতন, সামাজিক দুর্যোগ এই দেশ কতটা মনে রাখতে পেরেছে?
সুলতানা কামাল: ইতিহাস বাংলাদেশের সঙ্গে সদয় আচরণ করেনি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ক্ষমতা দখল করল, তাদের ধারণার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের কোনো মিল ছিল না। আমার মতে, এর অন্যতম কারণ হলো এই শাসকগোষ্ঠীর আমাদের একুশের চেতনা, এ দেশের গণমানুষের সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পন্ন ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার আন্দোলনের সঙ্গে কোনো পরিচয় বা যোগ ছিল না। তারা অধিকাংশই বরং বাংলাদেশের মানুষকে যারা পদানত করে রাখতে চেয়েছে, তাদেরই মানসিকতায় অভিষিক্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে শুধু একটা ভূখণ্ডকে শত্রুমুক্ত করে নিজের দখলে নিয়ে আসার যুদ্ধ ছিল না, ছিল মানুষের মুক্তির যুদ্ধ, সেই রাজনৈতিক আদর্শ এদের জানা ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। এখানে তার বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। বাস্তবতা এই যে, সে কারণেই কুড়ি বছর বাংলাদেশ উল্টোপথে হেঁটেছে। ওই সময়ের বাংলাদেশকে আমি বাংলাদেশ বলে চিনতে পারি না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সময়কালে দেশের মানুষের মন-মনন, চেতনা, সামাজিক সম্পর্কের সূত্র যেভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে, তা অভাবনীয়।
সমকাল: স্বাধীন বাংলাদেশেও কেন বারবার স্বাধীনতার চেতনা তথা গণতন্ত্র, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হয়?
সুলতানা কামাল: পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকদের দেশ পরিচালনার নীতি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সব আদর্শ আর চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে সচেষ্ট থেকেছে। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে যা কিছু একাত্তরের সঙ্গে যুক্ত, তা মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানুষের সামাজিক আচরণ সবকিছু তাদের ছাঁচে ঢেলে সাজিয়েছে। গণতন্ত্রকে তারা কখনও শিকড় গাড়তে দেয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা উপড়ে ফেলে অসাম্য আর বিভেদের রাজনীতির বীজ বপন করেছে মানুষের মনের ভেতরে আর সে কারণেই সাম্য আর মানবিক মর্যাদার বোধশূন্য এক জাতির মতো আচরণ আমাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমকাল: সুযোগ সামনে আসা সত্ত্বেও আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে যেতে পারলাম না কেন?
সুলতানা কামাল: বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে হলে রাজনীতিতে সেটার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আর কর্মসূচি থাকা উচিত ছিল। নাগরিক সমাজ দাবি তুলতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে, কখনও কখনও দিকনির্দেশনাও দিতে পারে। সমাজ গঠনেও তারা ভূমিকা রাখতে পারে যদি রাজনৈতিক শক্তি তাদের সহায় হয়। কারণ কাজটা রাজনীতির। সেই কাজটা যে রাজনৈতিক দলগুলোর দায় ছিল, বিশেষত আওয়ামী লীগ, হয় তারা সেটা বুঝতে পারেনি, নয়তো গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। তার ফলে তাদের ওপর যখন বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দায়িত্ব বর্তাল তারা যোগ্যতার সঙ্গে সেই কাজটা করতে পারেনি।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। তবুও কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না?
সুলতানা কামাল: একটা সমাজে নানা ধরনের চিন্তাভাবনা চেতনার ধারার টানাপোড়েন চলতে থাকে। সেখানে কোন ধারার সমাজচেতনা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে, তা নির্ভর করে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলোতে নেতৃত্বের চরিত্র কেমন তার ওপর; এবং এই তিন ক্ষেত্রের সমন্বিত কর্মকাণ্ডে একটি সমাজ নির্মিত হয়। অগণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি বিযুক্ত হয়েছে, রাজনীতি হয়ে পড়েছে চরম অসংস্কৃত এবং সমাজ ক্রমশ প্রতিক্রিয়াশীলতার আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে এগোনোর বদলে পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। অর্থনৈতিক উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা হতে হবে একটি সমাজের সামগ্রিক মানবিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে, যেখানে বিরাজ করবে সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার প্রতি সম্মানবোধ। বাংলাদেশ আজকে সেখানেই পিছিয়ে পড়েছে। রাজনীতিকরা তাঁদের নিজেদের ঘোষিত নীতি বাস্তবায়ন করতেও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি কীভাবে ক্রমেই শক্তি ও সংখ্যায় বৃদ্ধি পেল? এর জন্য প্রধানত দায়ী কারা বা কোন পরিস্থিতি?
সুলতানা কামাল: এই প্রশ্নের উত্তরে আগের কথাই বলতে হয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী কুড়ি বছর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তিকে রাষ্ট্রীয় আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালনপালন করা হয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ তাদের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই বিষবৃক্ষের বীজ ক্রমে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির আপসকামী ভূমিকাই এ জন্য মূলত দায়ী।
সমকাল: বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের করণীয় কী কী?
সুলতানা কামাল: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যেতে হবে। অনেকেই সেটা করছেন। তবে তার জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তির সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। বাকস্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে কোনো আপস না করার নীতিতে অটল থাকা এবং মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পূরণ করার মতো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। মোটকথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে দৃশ্যমান ও সোচ্চার হতে হবে। বচন আছে, দুর্বৃত্তের দাপট একটা সমাজের যতখানি ক্ষতি করতে পারে, ভালো মানুষের নিষ্ক্রিয়তা বা আপসকামিতা তার থেকেও বেশি ক্ষতিকারক হতে পারে।
সমকাল: এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের অনুরোধে সাড়া দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সুলতানা কামাল: আপনাকেও ধন্যবাদ, সমকালের জন্য শুভেচ্ছা।
মন্তব্য করুন