- অর্থনীতি
- খেজুর আমদানিতে শত কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি
খেজুর আমদানিতে শত কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি

খেজুরভেদে দামও ভিন্ন। কিন্তু চলতি অর্থবছর দেশে আনা সব ধরনের খেজুর একই এইচএস কোডে শুল্কায়ন হয়েছে। আমদানির বিদ্যমান উচ্চ শুল্ক ও কর ফাঁকি দিতেই এমন অপকৌশল নিয়েছেন অর্ধশত আমদানিকারক। প্রকৃত দাম গোপনের মাধ্যমে তাঁরা সরকারের শতকোটি টাকার বেশি শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন। সমকালের হাতে আসা এ-সংক্রান্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর কাস্টমসে প্রায় ৪৩৮ কোটি টাকার খেজুর আমদানির ঘোষণা দিয়েছেন আমদানিকারকরা। এ টাকার ওপর শুল্ক এবং কর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমদানি খেজুরের মূল্য প্রায় ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, বাকি টাকা দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
খেজুর আমদানিতে নয়ছয় স্বীকার করে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘সাধারণ ও উন্নতমানের খেজুর একই দামে শুল্কায়ন ঠিক না বলে আমরাও মানি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দেশওয়ারি শুল্কায়ন করলে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ কমে আসবে। কিন্তু তা না করে হঠাৎ দেড় থেকে আড়াই গুণ শুল্ক চাপিয়ে দিয়েছে।’ চলতি অর্থবছর খেজুর আমদানির আড়ালে সরকারের শতকোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আমি বলতে পারব না। কাস্টমস ভালো বলতে পারবে।’ প্রকৃত মূল্য গোপন করে বিদেশে টাকা পাঠানোর বিষয়ে সিরাজুল আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বিকল্প কোনো পথ হয়তো বের করেছেন। কেউ কেউ হুন্ডির মাধ্যমেও টাকা পাঠিয়ে থাকতে পারেন।’ সিরাজুল ইসলাম অ্যারাবিয়ান ফ্রুটস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের মালিক। চলতি অর্থবছর তাঁর প্রতিষ্ঠান ৯ হাজার ২১১ টন খেজুর একটি এইচএস কোডের বিপরীতে শুল্কায়ন করেছে, দাম পড়েছে কেজিতে ৮৪ দশমিক ৬৪ টাকা। তবে বাস্তবে সিরাজুলের দোকানেই খেজুর হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিক্রয় রসিদ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি কেজি মাবরুম ৮১০ টাকা, সায়ের ১২৩, আজওয়া ৬০০, আজওয়া ভিআইপি ৭৫০, দাবাস সিপস ২৮৮, খালাস ১৮০, সাফায়ী ছক্কা ৫৩০, মাবরুম ছক্কা ৮৬৬ ও দাবাস ক্রাউন ২৮৮ টাকায় বেচাকেনা করেছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারি প্রতিষ্ঠান মদিনা ফ্রুটস সেন্টারের দেওয়া এমন একটি রসিদ সমকালের হাতে এসেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা রসিদে এসব জাতের ১৩ হাজার ৬৩৫ কেজি খেজুর ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এ হিসাবে গড় দাম পড়ে ২৯২ টাকা। অথচ কাস্টমসে প্রতিষ্ঠানটি খেজুরের গড় আমদানি মূল্য উল্লেখ করেছে ৯০ থেকে ৯২ টাকা। এখন পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে এসব খেজুরের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃত মূল্য আমলে নিয়ে খেজুরের গড় দাম কেজিতে ৩৫০ টাকা ধরলেও চলতি অর্থবছর মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। কিন্তু এলসিতে এসব পণ্যের দাম দেখানো হয়েছে ৬৭৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে ১ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা ব্যবসায়ীরা হুন্ডি কিংবা অবৈধ অন্য কোনো মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুল্ক ফাঁকি দিতেই প্রকৃত মূল্য গোপন করছেন খেজুর ব্যবসায়ীরা। তাদের এ ফাঁকির পরিমাণ চলতি অর্থবছরেই শতকোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছর ৪৭ হাজার ৭৬৭ টন খেজুর শুল্কায়ন হয়েছে প্রায় ৪৩৮ কোটি টাকায়। বাস্তবে এসব খেজুরের দাম ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা।
এতদিন আড়াই কেজির ওপরে ও নিচের প্যাকেট এবং বস্তার প্যাকেটের ওপর শুল্ক নির্ধারণ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ পদ্ধতিতে পণ্যের দাম বেশি হলে শুল্কহারও বেশি আসত। এ জন্য শুল্ক ফাঁকির জন্য পণ্যের দাম কম দেখানোর মতো অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেছেন ব্যবসায়ীরা। এভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মদিনা গ্রুপ, অ্যারাবিয়ান ফ্রুটস, কচমচ এন্টারপ্রাইজ, শাহ আমানত ট্রেডিং, ওকেএম ট্রেডিং করপোরেশন, আম্বিয়া ট্রেড, শাহ জোবায়েরা, জান্নাত ট্রেডিং, মেসার্স সাউদার্ন, মেসার্স আল্লাহর রহমত, সুদীপ্ত ট্রেড, কে এস করপোরেশন, আলী জেনারেল, ফ্রেশ ফুড, ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স বশর মোল্লা অ্যান্ড কোম্পানি, মমতাজ উদ্দিন অ্যান্ড ব্রাদার্স, ইয়াসিন ইমপেপ, মেসার্স এজাজ অ্যান্ড সন্সসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠান।
তবে ‘গড়ে ৯০ টাকা কেজির খেজুর বাজারে ১৮শ’ শিরোনামে গত সোমবার সমকালে সংবাদ প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে এনবিআর। বিদ্যমান শুল্কহারে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, খেজুর আমদানির শুল্কহার আড়াই কেজির কম ওজনের প্যাকেট ২৫ এবং আড়াই কেজির বেশি ওজনের বস্তা বা কার্টনে ১০ শতাংশ। কিন্তু বুধবার থেকে কার্টনে আনা খেজুরের দাম প্রতি কেজি ১ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২ ডলার ৫০ সেন্ট, বস্তায় আনা খেজুর ৫০ সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ১ ডলার ২৫ সেন্ট করা হয়েছে। খেজুর আমদানি করে ব্যবসায়ীরা প্রকৃত মূল্য গোপন করার অভিযোগ থাকায় এ পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে ধারণা করছেন তিনি।
নতুন শুল্কহার স্থগিতের দাবিতে খেজুর ব্যবসায়ীরা বৃহস্পতিবার কাস্টম হাউসে দীর্ঘ বৈঠক করলেও সমাধান আসেনি। রোববার আবার বৈঠকে বসবেন আমদানিকারকরা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা জানান, খেজুরের দাম নিয়ে নয়ছয়ের বিষয়টি আগেই এনবিআরকে জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় আগের নিয়মেই শুল্কায়ন করেছেন তাঁরা।
সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কাস্টমসের নথি অনুযায়ী এবার আমদানি খেজুরের গড় দাম ৯১ টাকা ৭৫ পয়সা কেজি। বাস্তবে পাইকাররা ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে ৩৫০ টাকা দর ধরেই বিক্রি করছেন। অথচ কাস্টমসে শুল্ক ও কর ফাঁকি দিতে তাঁরা প্রকৃত দামের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ কম দেখিয়েছেন। অভিযানে এমন তথ্য পেয়েছি।’ ভ্রাম্যমাণ আদালতের আরেক ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, ‘বেশ কিছু আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ী থেকে বিক্রয় রসিদ সংগ্রহ করেছি। তাতে উন্নতমানের খেজুরের দাম বর্তমান ঘোষিত দামের চেয়ে অনেক বেশি।’
মন্তব্য করুন