যুদ্ধের জেরে রাশিয়ায় তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের সব ধরনের পণ্য রপ্তানি কমে অর্ধেকে নেমেছে। গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটি প্রতিবেশী ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়। এর পর গত মার্চ থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাশিয়ায় রপ্তানি কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো রাশিয়ায় ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হওয়া এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা।

এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেনে বৈশ্বিক ব্যাংকগুলোর নিষেধাজ্ঞায় রপ্তানিমূল্য শতভাগ বুঝে পাচ্ছেন না অনেক রপ্তনিকারক প্রতিষ্ঠান। সময়মতো মূল্য না পাওয়ায় অর্থ সংকটে কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ঢাকার সবুজবাগের এমন একটি কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে জানান, যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ায় পোল্যান্ডভিত্তিক ব্র্যান্ড এলপিপির কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ ডলার মূল্যের একটি রপ্তানি আদেশ পান তাঁরা। যুদ্ধ শুরু হলে সব প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বিপদে পড়েন তাঁরা। অনেক দেন-দরবারের পর পর্যায়ক্রমে কিছু পোশাক নিয়েছে, কিছু মূল্যও পরিশোধ করেছে এলপিপি। তবে এখনও অনাদায়ী অর্থ অর্ধেকের মতো। এক বছর ধরে অর্থ সংকটে নতুন করে আর রপ্তানি আদেশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় ব্যাংকও অর্থায়ন করতে রাজি হয়নি। কারখানা এবং নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন তিনি। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধ শুরুর আগে মোট ৩৪টি কারখানা রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানি করত। অনেক কারখানাই এখন আর দেশটিতে রপ্তানি করছে না।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে রাশিয়াকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচনা করে আসছিলেন উদ্যোক্তারা। যুদ্ধের আগে এক বছরে প্রায় ৮০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে। এ ছাড়া রাশিয়ার মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর জোট কমনওয়েলথ অব ইনডিপেন্ডেন্ট স্টেটসের (সিআইএস) ১১টি দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির জন্য সম্ভাবনাময় বাজার মনে করা হয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা যায়, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর আগের মাস জানুয়ারিতে রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি শেষে রপ্তানি আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি হয়। মার্চে তা ৫৫ শতাংশ কমে যায়। যুদ্ধের পরের মাসগুলোতেও রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। গত বছরের মার্চ থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, অর্থাৎ যুদ্ধের এক বছরে রাশিয়ায় রপ্তানি কম হয়েছে ৫৩ শতাংশ। প্রায় ৭৯ কোটি ৪২ লাখ ডলারের রপ্তানি ৩৯ কোটি ৬১ লাখ ডলারে নেমে আসে। রাশিয়ায় উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে– পোশাক, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, পাট, সিরামিক, সবজি, বিভিন্ন ধরনের মাছ ইত্যাদি।

যুদ্ধের এক বছরে পোশাকের রপ্তানি কমেছে ৪৯ শতাংশ। যুদ্ধ শুরুর আগে এক বছরে রাশিয়ায় ৭১ কোটি ৯২ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। যুদ্ধের এক বছরে তা ৩৬ কোটি ৮১ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের পোশাক গেছে রাশিয়ায়। যুদ্ধ শুরুর আগের একই মাসে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। পোশাকের মধ্যে নিট ক্যাটাগরির পণ্য বেশি যেত।

নিট পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভপতি এবং ফতুল্লা আ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান সমকালকে বলেন, রাশিয়ায় সরাসরি রপ্তানিতে তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করা যাচ্ছে না। তার পরও রাশিয়ায় সরাসরি রপ্তানি হচ্ছে না। কারণ, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো দেশটিতে ব্যবসা করছে না। তৃতীয় দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া এবং দুবাইয়ের মাধ্যমে এখন কিছু পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানি হয়। এ ছাড়া রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বেড়েছে। ওই সব দেশের মাধ্যমে রাশিয়ায় কিছু পোশাক যচ্ছে। তাঁর আশা, আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি আবার স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে পারে। কারণ, বৈশ্বিক বড় ব্র্যান্ডগুলোর শোরুম স্থানীয়রা কিনে নিচ্ছে। কিছু ব্র্যান্ড রাশিয়ায় আবার ব্যবসা শুরু করবে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।