
ঋণ অনুমোদনের প্রায় তিন মাস পর আবারও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেল। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ ছাড়া ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন ও সংস্কারে আমাদের আগামী অর্থবছরের বাজেটে কী থাকছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এতে তারা যে সন্তুষ্ট– তা বলা যাবে না।
বৈদেশিক মুদ্রার এখনকার রিজার্ভ এবং আগামী জুনের সম্ভাব্য পরিমাণ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেনি আইএমএফ। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা। কিন্তু সে লক্ষণ তারা দেখতে পাচ্ছে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইএমএফের এ মিশন ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানোর পক্ষে। এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের মনোভাব তারা বুঝতে চেয়েছে। তবে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সরাসরি কিছু জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা আইএমএফ মানছে না। আমরা জানি, রিজার্ভের অর্থ বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করা হয়েছে; রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠনে ব্যবহৃত হয়েছে; উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশ বিমানকে সহায়তার জন্য সোনালী ব্যাংককে ধার প্রদান করা হয়েছে এবং পায়রাবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন বাবদও ব্যয়িত হয়েছে। এ সব কিছুই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ সংক্রান্ত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। শ্রীলঙ্কাকে ধার দেওয়া ৮২০ কোটি ডলারও কিন্তু এতে রয়েছে। আইএমএফ বলছে, এগুলো বাদ দিলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০৮ কোটি ডলার।
প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ মিশনের সদস্যরা শুধু জুনের মধ্যে রিজার্ভের শর্ত পূরণ না হওয়া নয়; আগামী সেপ্টেম্বর এমনকি ডিসেম্বরের জন্যও একই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারণ, শর্ত অনুসারে তখন রিজার্ভ আরও বাড়িয়ে রাখতে হবে। যেমন আইএমএফের মানদণ্ড অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২ হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারের নিচে থাকতে পারবে না।
আইএমএফের ঋণ পাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পরই যেটি আলোচনা হয়েছিল তা হচ্ছে, বিদ্যুতের দাম কি আরও বাড়বে? ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সঙ্গে দেওয়া শর্তের মধ্যে গত জানুয়ারিতে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার উন্নতির কথাও বলেছিল আইএমএফ। ভর্তুকি কমাতে আইএমএফের ঋণ অনুমোদনের আগেই সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, সারের দামও বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম এখন আন্তর্জাতিক বাজারদরের কাছাকাছি।
রাজস্ব-জিডিপি হারের উন্নতি কীভাবে করা যাবে, তা নিয়েও আইএমএফ কথা বলেছে। আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আয় অর্থাৎ রাজস্ব-জিডিপির হার বৃদ্ধি নিয়ে আইএমএফের দলটির প্রশ্ন বেশি ছিল বলে জানা গেছে। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ কর আদায়ে রাজস্ব খাত সংস্কার নিয়ে সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য আইএমএফ চায় রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে এনবিআর কতটা সফলতা দেখাতে পারে তা দেখতে হবে। আমরা ধরে নিচ্ছি, আগামী দুই মাসে কিছু ডলার আসবে। তবে রিজার্ভটা আইএমএফের জুনের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে সরকারের উচিত হবে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া। রিজার্ভে আইএমএফের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারাটা বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না। বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশে বর্তমানে কর-জিডিপির হার সাড়ে ৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন; এমনকি বিশ্বেও তা নিম্নতম।
কৃষিতে ভর্তুকি বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। কারণ, ভর্তুকি পশ্চিমা দেশেও রয়েছে। ফ্রান্স, কানাডাও কৃষিতে ভর্তুকি দেয়। আমাদের কৃষকদেরও ভর্তুকি প্রয়োজন। এর সঙ্গে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। সার্বিক স্বার্থে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর পরিবর্তে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সরকার অন্য খাতে কিছুটা ব্যয় কাটছাঁট করতে পারে। আমরা সংকটের মধ্যে আছি; কিংবা আমরা একেবারেই সংকটে নেই– এমনটা বলা যাবে না। আরও একটি দুশ্চিন্তার বিষয়, আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সময় চলে এসেছে। যদিও বিগত দিনে আমাদের খেলাপি হওয়ার কোনো রেকর্ড নেই, তার পরও তা ভাবনার বিষয়। উপরন্তু বৈদেশিক উৎস থেকে গৃহীত বেসরকারি খাতে ঋণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব ঋণ সঠিক জায়গায় ব্যয় হয় না। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আয়ও আসে না।
আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে তা এখন নিয়ন্ত্রণে নেই। সুতরাং আইএমএফ যে চ্যালেঞ্জগুলো দেখছে, সেগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এত সহজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অর্থনীতির ওপর অন্য অভিঘাত পড়বে। ব্যাংক ঋণের সুদ বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে গেলে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে প্রায় ১২ শতাংশ হয়েছে। অথচ মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ শতাংশ। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না করলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মানুষের কষ্ট বাড়ছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই।
যদিও বৈশ্বিক বাজারে কিছু জিনিসের দাম কমতে শুরু করেছে, আমাদের এখানে বরং ঘটছে উল্টো। জ্বালানি তেলের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সামনে নির্বাচন আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছি। নির্বাচনের অনিশ্চয়তার কারণে নতুন বিনিয়োগ কম হচ্ছে। প্রতিনিয়ত কমতির দিকে রিজার্ভ। ডলার সংকটে এলসি খুলতে পারছে না অনেক ব্যাংক। আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ সব কিছুই দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে প্রবৃদ্ধি কম হলেও অর্থনীতিকে কীভাবে স্থিতিশীল করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া। কমতে থাকা রিজার্ভকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে করতে হবে। মোট কথা, সব দিকে সাশ্রয়ী হওয়া এবং অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় সুশাসনে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; সাবেক
গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
মন্তব্য করুন