
হালে বিশ্বজুড়ে একটি নতুন ধারণা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে– ‘ডি-ডলারাইজেশন’। এর অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, অর্থ ও ব্যাংকিং লেনদেনে ডলারের ক্রমহ্রাসমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ব্যবস্থা করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারের বন্দোবস্ত করে। এই ব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু ডলার নয়; বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য অন্যান্য দেশের মুদ্রাও সংরক্ষণ করবে। বর্তমানে অনেক দেশ রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ইউএস ডলারের বিপরীতে তাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করছে ও করার প্রক্রিয়ায় আছে।
অনেকেই জানেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হচ্ছে কোনো একটি দেশের হাতে থাকা বিদেশি মুদ্রাকে বোঝায়, যা সাধারণত রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। ধরা যাক বাংলাদেশের কাছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে। তার মানে বুঝতে হবে, বাংলাদেশ এই মুদ্রা বিদেশে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জন করেছে। যে দেশের পণ্য-সম্পদ রপ্তানির পরিমাণ যত বেশি তাদের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও তত বেশি। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে হয় আমদানির জন্য।
কেন ডি-ডলারাইজেশন
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এতদিনে ডলারের মাধ্যমেই প্রায় সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি নির্ভর করত। কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেনে অভিযানের পর বিশ্ব-অর্থনীতির অনেক কিছুই যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ডলার ছাপানো ও সুদের হার বৃদ্ধিতে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো আমদানি বাণিজ্যের জন্য অধিক অর্থ খরচ করতে গিয়েও মূল্যস্ফীতি তৈরি হচ্ছে। সর্বোপরি মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তির রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বাণিজ্যিক অবরোধ ও তাদের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দেওয়ায় এই সংকট আরও জটিল হয়। বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের একাধিপত্য থাকায় রাশিয়ার অভিজ্ঞতার পর প্রায় সব দেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এতে বিশ্বে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো ভবিষ্যৎ নিরাপত্তায় ডলার বাদ দিয়ে তাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারে তৎপর হয়।
ডি-ডলারাইজেশন সম্প্রতি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা দ্য ক্রেডিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়। ২০০১ সালে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের অংশ ছিল ৭৩ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ৫৫ শতাংশে নেমেছে এবং ২০২২ সালে হয়েছে ৪৭ শতাংশ। গত বছর ডলারের চাহিদা গত দুই দশকের গড় থেকে ১০ গুণ দ্রুত কমেছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক লেনদেনে ডলারের অংশ ৩০ শতাংশে নেমে আসা অবিশ্বাস্য কিছু নয়।
বৈশ্বিক শক্তির পরিবর্তন
গত কয়েক দশকে বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। চীন, ভারত বড় জনসংখ্যা ও অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে চীন রপ্তানি বাণিজ্যে বিশ্বে বৃহত্তম শক্তি। কোনো দেশ যদি রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে তাহলে তার মুদ্রাও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে কারণে চীনের মুদ্রা ইউয়ান এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ডলার সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। শুধু তাই আন্তঃসীমান্ত লেনদেনে ইউয়ান ইতোমধ্যে ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে। চীন-রাশিয়া তাদের বাণিজ্যের ৭০ ভাগই করছে ইউয়ান-রুবলে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা গত মাসে চীন সফরে গিয়ে বলেন, ‘ডি-ডলারাইজেশন’ তাঁর সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার। ইতোমধ্যে চীন ও ব্রাজিলের মধ্যে ডি-ডলারাইজেশন চুক্তি হয়েছে। এতে মার্কিন রাজনীতিকরা ক্ষুব্ধ হলেও চীন খুশি।
এনডিবি ব্যাংক
মার্চে ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ চীন-সাংহাইভিত্তিক নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। যাকে ব্রিকস ব্যাংক নামেও অভিহিত করা হয়। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হিসেবে ২০১৪ সালে এনডিবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর যে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সংস্থার জন্ম দেওয়া হয়। ব্রিকস ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর দিলমা চীনের প্রধান মিডিয়া সিজিটিএনকে বলেন, মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের মাধ্যমে ডলারের একাধিপত্য খর্ব করাই তাঁদের লক্ষ্য।
জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ডি-ডলারাইজেশন
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য একটি সাধারণ মুদ্রা তৈরির বিষয়ে আলোচনা করে। শুধু তাই নয়, তারা লাতিন আমেরিকার জন্যও একটি অভিন্ন মুদ্রার কথা উল্লেখ করে।
এ বছরের শুরুতে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট নেশনস (আসিয়ান) দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী নিয়ে সিঙ্গাপুরে একটি বৈঠক করে ডলার, পাউন্ড, ইউরো, ইয়েনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহার নিয়ে কথা বলেন। সেখানে তাঁরা ক্রসবর্ডার ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের অনুমোদন করেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এশিয়ায় একটি অভিন্ন মুদ্রা চালুর প্রস্তাব করেন।
তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবও তাদের নীরবতা ভেঙেছে। তারাও ঘোষণা করেছে– তারা শুধু ডলারে নয়, অন্যান্য মুদ্রায়ও তাদের বাণিজ্য উন্মুক্ত করবে। রাশিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশও ডলারকে আর একক মুদ্রা ভাবছে না। তারা তাদের নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবসা করে।
ভবিষ্যৎ
তবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ডলার তার একাধিপত্য হারালেও রাতারাতি এর গুরুত্ব কমে যাবে– এমনটা ভাবার কারণ নেই। কেননা, এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ৬০ শতাংশ ডলারই রাখছে। ডি-ডলারাইজেশনের গতি ও ব্যাপ্তি নির্ভর করবে বিভিন্ন দেশের ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার ওপর। মুদ্রার বহুমুখী ব্যবহার, ডিজিটাল মুদ্রা গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার সাফল্যের ওপর। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা-নেতৃত্বের পরিবর্তন ও মুদ্রা বৈচিত্র্যের আকাঙ্ক্ষাই ডি-ডলারাইজেশনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন