উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং আইএমএফের শর্তের কারণে এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে এক কঠিন পরিস্থিতিতে। তবে বাজেট হয়েছে গতানুগতিক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পারবে না জেনেও রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এনবিআর যেন অর্জন করতে পারে এমন লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া উচিত ছিল। এরপর না পারলে জবাবদিহির আওতায় আনা যেত।
রাজস্ব আয়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকলেই ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুস্থ মাথায় চিন্তা করা হয়নি। ভাবা হয়েছে, এটা করলেই মানুষ কর দেবে, কর বেড়ে যাবে এবং সবাই করের আওতায় আসবে। দেশের সংস্কৃতি, মানুষের প্রবণতা, কর গ্রহণকারীর মানসিকতা, তার ব্যবহার– এসব মাথায় নিয়ে এমন চিন্তা করতে হবে। তা না করলে বুমেরাং হবে। বেশি চাপাচাপি করলে বরং জাল কর সনদ জমা দেবে। আর এর পেছনে তখন কে দৌড়াবে। ২ হাজার টাকা যে দেবে নগদ তো দিতে পারবে না। পে-অর্ডার করে দিতে হবে। এর পেছনে একটা খরচ আছে। আবার টাকা দিতে ব্যাংকে যেতে হবে।
করোনা ও বর্তমান বৈশ্বিক কারণে পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি একটা সংকটকালীন সময় পার করছে। আমরা ইতোমধ্যে সংকটের মধ্যে পড়েছি। এ সময়ে গতানুগতিক বাজেট দিয়ে সংকট কাটানো যাবে না। বরং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। যেমন– এখন দেশে বেকারত্বের সমস্যা। এটি দূর করতে হলে শিল্প গড়ে তুলতে হবে, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে, ভালো শিক্ষা দিতে হবে এবং তার স্বাস্থ্য ভালো থাকতে হবে। এসবের জন্য সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। তা না করে বাজেটে অতীতের কিছু প্রশংসা দেখে মনে হবে দেশে কোনো সমস্য নেই। সব ভালোভাবে চলছে। আবার বাজেটে এমন কিছু কথা বলা হয়েছে যা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এরপরও জনগণকে বুঝ দেওয়ার জন্য এ ধরনের  কথা বলা হয়।

সংসদীয় গণতন্ত্রে বাজেট সরকারের সঙ্গে জনগণের এক ধরনের চুক্তিনামা। বাজেটে যা বলা হবে জনগণ তা জেনে তার আলোকে চলবে। তবে এখন বলার ভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত বড় বক্তব্য যা পড়েই শেষ করা সম্ভব নয়। পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে বাজেট উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে কী থাকছে না থাকছে বোঝা যাচ্ছে না। এতে করে সরকার বা জনগণ কোনো দিক থেকে দায়িত্ববোধের জায়গা তৈরি হচ্ছে না।

এবারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ। এখনই মূল্যস্ফীতি আছে ৯ শতাংশ। ধীরে ধীরে সেটা দুই অঙ্কে যাচ্ছে। এখন দেশে এমন কোনো ঘটনা বা দোয়া-দরুদ নেই যেটা এ মুহূর্তে ৬ শতাংশে আনা যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধি খেয়ে ফেলবে।
উন্নয়ন বাজেটের বিষয়ে বলব– একটা প্রকল্প করার আগে দেখা দরকার  যে তার প্রয়োজনীতা কতটুকু। আবার যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করা যাবে কিনা। একটা প্রকল্প হয়তো ৫ বছরে শেষ করার কথা, কিন্তু  শেষ হলো ১৫ বছরে। এতে একদিকে প্রকল্পের খরচ অনেক বাড়বে, আবার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার পরবর্তী ১০ বছরে সেখান থেকে কোনো আয় আসবে না উল্টো বিনিয়োগ করতে হবে। পদ্মা সেতু করা হয়েছিল শিল্প গড়ে উঠবে, তাতে জিডিপিতে দুই শতাংশ যোগ হবে এমন কথা বলে। এখন আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার আনন্দ করছি। তবে আনন্দ ততক্ষণ অর্থবহ হবে না, যতক্ষণ না এর ফল পাব। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার আগে ভাবা উচিত ছিল মাঝেমধ্যে কয়লা নাও পেতে পারি। বড় বড় প্রকল্প করতে আমরা বিদেশ থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছি। অথচ জনগণ জানে না, সংসদ জানে না। এসব নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে আলোচনা করলে সবার মাঝে মালিকানা প্রতিষ্ঠা হয়।
সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড