
প্রস্তাবিত বাজেটের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে সামষ্টিক দিকটাতেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর সেদিক থেকে বাজেটের বিশ্লেষণ করতে হলে যে সংখ্যাটা আমরা সবার আগে দেখি, তা হলো বাজেট ঘাটতি। বাজেট ঘাটতি যদি বাড়ে তখন তাকে সম্প্রসারণমূলক বাজেট বলা হয়। সে অর্থে সহজেই বলা যায় যে, প্রস্তাবিত বাজেট একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা ২ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ বেশি। আবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকে দেখলেও একই রকম চিত্র পাওয়া যায়। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা ৫ দশমিক ১ শতাংশ। আবার বাজেট ঘাটতির মোট অঙ্কটা আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রায় সমান। এডিপির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার হাজার কোটি টাকা। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, তিনটি মানদণ্ডেই প্রস্তাবিত বাজেট সম্প্রসারণমূলক।
সম্প্রসারণমূলক বাজেট ভালো নাকি মন্দ তা নির্ভর করে অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার ওপর। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এখন নানা চাপের মধ্যে রয়েছে। চাপের মধ্যে দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর একটি হচ্ছে মাসের পর মাস ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি রয়েছে ৯ শতাংশের ওপরে। আরেকটি চাপের বিষয় হচ্ছে ডলারের সংকট, যে কারণে রিজার্ভ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। এই দুটি চাপের সঙ্গে প্রস্তাবিত সম্প্রসারণমূলক বাজেট সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এবারের বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো সম্প্রসারণ। এটি অর্থনীতির বিষফোড়া আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
আমাদের যদি মূল্যস্ফীতি কম থাকত আর যদি পর্যাপ্ত ডলার রিজার্ভ থাকত, তাহলে সম্প্রসারণমূলক বাজেট অর্থনীতির জন্য ভালোই হতো। কিন্তু দুটির মধ্যে কোনোটিই নেই। বরং উল্টো অবস্থা দেখা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি খুব বেশি। রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। কাজেই এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে প্রস্তাবিত বাজেট সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। এই বাজেটের ফলে মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের ওপর কতটা চাপ পড়বে– তা নির্ভর করছে ঘাটতি কীভাবে অর্থায়ন করা হবে তার ওপর। ঘাটতির অর্থায়নের বেশিরভাগই যদি বৈদেশিক সহায়তার মাধ্যমে করা হতো তাহলে রিজার্ভের ওপর ততটা চাপ সৃষ্টি হতো না। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে যে অর্থায়ন পরিকল্পনা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকাই অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন। বিদেশি অর্থায়নের চেয়ে তা বেশি। বিদেশি অর্থায়ন ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থা থাকলে রিজার্ভের ওপর যেমন চাপ আসবে, তেমনি মূল্যস্ফীতির ওপরও চাপ আসবে। আর মূল্যস্ফীতিতে কেমন চাপ আসবে, তা নির্ভর করছে ব্যাংক ব্যবস্থায় অর্থায়নটা কীভাবে করা হবে তার ওপর।
চলতি অর্থবছরে আমরা দেখেছি, অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের বড় অংশই সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে। মানে টাকা ছাপিয়ে নিয়েছে। এটি মূল্যস্ফীতির জন্য খুবই উদ্বেগজনক। আগামী অর্থবছরেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অর্থায়নের সিংহভাগই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া হলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিলে মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলেও তুলনামূলক কম হতো। সে ক্ষেত্রে আবার ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে সমস্যা হতে পারে। যদিও ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণের চাহিদা এখন দুর্বল। ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘাটতির অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন করা হলেও চলতি অর্থবছর যেভাবে হয়েছে, সেভাবে যেন আর না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এই হলো সামষ্টিক দিক থেকে বাজেট নিয়ে পর্যবেক্ষণ।
দ্বিতীয় একটি দিক হচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের বড় একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে যা রয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যদিও সেটাও অর্জিত হবে না। আমার ধারণা, সরকার বাড়তি রাজস্বের বেশিরভাগই পরোক্ষ কর থেকে নেওয়ার কথা ভাবছে। মানে ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক থেকে। সেখান থেকে রাজস্ব হয়তো আসবে। কিন্তু সেটাও কিন্তু মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ বাজেটে অনেকগুলো পণ্যের শুল্ক-ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। সেগুলোর দাম তো বাড়বে। পরোক্ষ করের পরিবর্তে এ মুহূর্তে প্রত্যক্ষ কর বিকল্প হতে পারত। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট অনুসারে প্রত্যক্ষ কর থেকে খুব বেশি আসবে না।
রাজস্বের ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। যেমন– যে কর প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে সিগারেট থেকে অতিরিক্ত ৫ হাজার কোটি মতো আসতে পারে। এই করারোপ স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। দ্বিতীয় গাড়ি কেনার জন্য করহার বাড়ানো হয়েছে। এটাও ভালো দিক। যানজট বা বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণে ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খুব বেশি কর হয়তো আসবে না। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে অনেক দিনের একটি দাবি ছিল করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো। এটি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ২ হাজার টাকার একটি বাধ্যতামূলক কর আরোপ করা হয়েছে বিভিন্ন সেবা পেতে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলেও ২ হাজার টাকার বাধ্যতামূলক কর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বোঝা বাড়াবে। অন্যদিকে সম্পদের ওপর সারচার্জের সীমা বাড়ানো হয়েছে। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই ধরনের কিছু বিষয় করের ন্যায্যতার নীতির সঙ্গেও যায় না।
প্রস্তাবিত বাজেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যয় কাঠামো। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যয়ের যৌক্তিকীকরণ খুব দরকার ছিল। যেসব ব্যয় কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না, সেগুলো বাদ দেওয়া বা কমানো দরকার ছিল। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। এডিপিতেও গতানুগতিক বরাদ্দ আছে। সেখানেও ব্যয়ের যৌক্তিকীকরণ ঘটেনি। রপ্তানিতে প্রচুর ভর্তুকি দেই আমরা। এর লক্ষ্য ছিল রপ্তানি বহুমুখীকরণ। কিন্তু রপ্তানির বহুমুখীকরণ তো হচ্ছে না। আবার ভর্তুকির সুবিধার অপব্যবহারও হচ্ছে। রেমিট্যান্সেও ভর্তুকি কাজে আসছে না। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে এই ভর্তুকি দেওয়া হয়। সেটাও তো সেভাবে হচ্ছে না। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তায় ভাতা বাড়ানো দরকার ছিল, কর্মসংস্থানে সহায়তা বেশি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ভর্তুকি কমিয়ে এদিকে বরাদ্দ দেওয়া যেত। ব্যয়ের কাঠামোতে মোটাদাগে যৌক্তিকীকরণের কিছু দেখা যাচ্ছে না।
লেখক : সাবেক লিড ইকোনমিস্ট, বিশ্বব্যাংক
মন্তব্য করুন