- অর্থনীতি
- নির্বাচনী বছরে আরও চাপ
নির্বাচনী বছরে আরও চাপ

অর্থনীতির জন্য সময়টা খুব কঠিন। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ধীরগতি, ডলার সংকটসহ নানা অস্বস্তির মাঝে একটি স্বস্তির বাজেট আশা করেছিলেন সবাই। বাজারে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে আশা ছিল, নির্বাচন সামনে রেখে এ কষ্ট লাঘবের দিকেই সরকারের মনোযোগ থাকবে। গরিব মানুষের দিকে নজর থাকবে বেশি। বেকারদের জন্য বড় খুশির খবর দেবেন তিনি। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান চাঙ্গা করার দিক গুরুত্ব পাবে। কিন্তু এসব বিষয়ে বাজেটের পদক্ষেপে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির টিকে থাকার সংগ্রাম থেকে রেহাই দেওয়ার তেমন পদক্ষেপও নেই। বরং কিছু কর পদক্ষেপে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদেরও তেমন খুশি করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। সব মিলিয়ে চলমান অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ কম। বরং নতুন করে কিছু অস্বস্তি যোগ করল বাজেট।
তবে অর্থমন্ত্রীর সব প্রস্তাবই যে জনগণের জন্য অস্বস্তির হবে– তা বলা যাবে না। করমুক্ত ব্যক্তি আয়ের সীমা বাড়ানোর মতো কিছু স্বস্তিদায়ক পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। নতুন অর্থবছরেই সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন। আরও কিছু পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে।
অবশ্য প্রচুর আশাবাদের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তাঁর ১৯৮ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তব্যে সরকারের অর্জন এবং আশাবাদের কথাই বেশি। জিনিসপত্রের বেড়ে যাওয়া দাম কমে আসার জন্য তিনি বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভর করেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের দাম কমছে এবং এর ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে তিনি আশা করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক দিন ধরেই পণ্যের দর কমছে, অথচ দেশে কমে না। এ রকম অবস্থায় অনেক পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে এবং বাড়ানো হয়েছে। এতে বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয় বাড়াতেই হবে এবং এ কারণে এসব পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
এবারের বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘উন্নয়নের দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।’ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তরুণরাই হবে উন্নত বাংলাদেশের পথে স্মার্ট অভিযাত্রার অন্যতম সারথি। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য গবেষণা কার্যক্রমে ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দও রাখা হয়েছে। কিন্তু যে তরুণরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বেন, তাঁদের কর্মসংস্থানের জন্য চোখে পড়ার মতো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। তরুণদের গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো। কিন্তু সেই বরাদ্দ বরাবরের মতো জিডিপির ১ শতাংশের নিচে রয়ে গেছে। যদিও নির্বাচনী বছরে বাজেটের মোট ব্যয় সম্প্রসারণমূলক রাখা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী গতকাল বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বিশেষ বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুমোদন দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন আগামী অর্থবছরের বাজেট এবং চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করার জন্য সম্মতি দেন। এবারের বাজেট দেশের ৫২তম এবং বর্তমান সরকারের পঞ্চম বাজেট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত গত তিনটি সরকারের ১৫তম বাজেট এটি।
এবারের বাজেট করার ক্ষেত্রে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার শর্ত পালনের বিষয়টি অর্থমন্ত্রীকে মাথায় রাখতে হয়েছে। আইএমএফের নাম মুখে না আনলেও, তাদের শর্ত অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এতে এর দাম বাড়বে নাকি কমবে– সে রকম ইঙ্গিত অবশ্য দেননি। আইএমএফের অন্যতম শর্ত হলো কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো । ব্যয় বাড়ানো এবং বাজেট ঘাটতি কমাতে কর সংগ্রহ বাড়াতে হবে– তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু কর সংগ্রহ বাড়াতে অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন ভ্যাট আরোপ এবং বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, যার মধ্যে শিক্ষার অন্যতম উপকরণ কলম এবং বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রীও রয়েছে। আবার করযোগ্য আয় নেই অথচ বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন দাখিল করতে হয়– এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাবকে বিশেষজ্ঞরা ‘অন্যায্য’ বলে মন্তব্য করেছেন। কর আদায় বাড়াতে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী সংগঠন বলেছে, এ ধরনের কার্যক্রম শুরুর আগে ভালোভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। কারণ এ ক্ষেত্রে করদাতাদের হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা (৭ দশমিক ৫ শতাংশ) নেওয়া হয়েছে। অথচ রপ্তানি খাত যখন বড় সংকটে পড়েছে, তখন তাদের মূল দাবি আমলে নেওয়া হয়নি। রপ্তানি পণ্যের ওপর উৎসে কর আগের মতো ১ শতাংশই রয়ে গেছে। অনেক আমদানি পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। আমদানির তুলনায় স্থানীয় উৎস থেকে ভ্যাট বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় শিল্পের উন্নয়নে নতুন প্রণোদনা নেই। বরং স্মার্টফোনসহ কয়েকটি শিল্পে বাড়তি ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে মোটাদাগে ব্যবসায়ীরাও খুশি হতে পারেননি।
বাজেটে কিছু স্বস্তির দিকও রয়েছে। গরিব মানুষের জন্য বাজেটে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ সামান্য বাড়ানো হয়েছে। এ উদ্যোগ ভালো । আবার আগের চেয়ে আরও মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তায় আনার উদ্যোগও ইতিবাচক। কিন্তু বাজেটের মোট বরাদ্দের অনুপাতে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ কমেছে। আবার জিডিপির অংশ হিসেবেও কমেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দেও একই অবস্থা। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলতি অর্থবছরের দায় টানতে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। যদিও আইএমএফের শর্ত রয়েছে– ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া ঋণের সুদ পরিশোধেই চলে যাবে বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি অর্থ।
নির্বাচনী বছরের বাজেটে সরকার জনতুষ্টির জন্য কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা নিয়ে বাজেটের আগে আলোচনা ছিল। কিন্তু অর্থনীতির বর্তমান সংকটের কারণে সেদিকে খুব বেশি পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অবশ্য সরকারের উন্নয়ন ব্যয় পরিকল্পনায় মেগা প্রকল্পগুলোতে বাড়তি নজর দেওয়া, বিভিন্ন খাতে বড় অঙ্কের থোক বরাদ্দের মতো পদক্ষেপ রয়েছে। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, সব মানুষের আশা-প্রত্যাশা ও উন্নয়ন ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর প্রত্যয়ে সাজানো হয়েছে এবারের বাজেট। জনগণের জন্য নতুন নতুন আশা ও সুবিধার সমন্বয় করা হয়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ ও কর প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিফলন কম।
পরিসংখ্যান
আগামী অর্থবছরে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাজেটের আকার দাঁড়াচ্ছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ ধরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়। চলতি বাজেটের তুলনায় আসন্ন বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা।
ব্যয়ের বিপরীতে সরকারের মোট রাজস্বপ্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আসবে। এনবিআর-বহির্ভূত কর থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বৈদেশিক অনুদান হিসেবে আসবে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অনুদানসহ মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে অনুদান ব্যতীত মোট ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদানসহ ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩২ কোটি টাকা; সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার।
আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার পরিচালন ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এ ছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
মন্তব্য করুন