গত ৩০ মে বায়ুদূষণের তালিকায় আবারও শীর্ষে ছিল রাজধানী ঢাকা। আবহাওয়ার মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক অনুসারে ঢাকার বায়ুর (বাতাস) মানের স্কোর ছিল ১৬৬। এ স্কোরের অর্থ হচ্ছে, ঢাকার বাতাসের দূষণমাত্রা ‘অস্বাস্থ্যকর’। মাঝেমধ্যেই ঢাকা বায়ুদূষণে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। মূলত বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং ওজোনের পরিমাণের ওপর নির্ণয় করা হয় বায়ুমান। এর ভিত্তিতে বিপজ্জনক, খুবই অস্বাস্থ্যকর, অস্বাস্থ্যকর, বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য অস্বাস্থ্যকর, সহনীয় এবং ভালো বায়ু– এই কয় ভাগে ভাগ করা হয়। বায়ুমানের এই শ্রেণিবিন্যাসে ঢাকার অবস্থান অস্বাস্থ্যকর এবং বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ ব্যক্তির তালিকায় রয়েছে বয়স্ক, শ্বাসকষ্টের রোগী, উচ্চ রক্তচাপের রোগী, ক্যান্সারের রোগী এবং শিশু। অস্বাস্থ্যকর বায়ুমান শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া মাথাব্যথা, অনিদ্রা, মেজাজের অস্থিরতা, উচ্চরক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট–এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারেরও কারণ হতে পারে বয়স্কদের ক্ষেত্রে। ২.৫ মিলিমিটার বা তার চেয়ে আকারে ছোট এ বিষাক্ত পদার্থগুলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে। পরে এগুলো রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ও বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা সৃষ্টি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমান নির্দেশিকায় ৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ এবং ১০ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রাস অক্সাইডের গড় উপস্থিতি স্বাস্থ্যকর ঘোষণা করা হয়েছে। আমেরিকার হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন নামক দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৭১.৪ মাইক্রোগ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুতে। নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ পাওয়া গেছে ২৩.৬ মাইক্রোগ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুতে। বিভিন্ন গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, বাড়িঘরে ব্যবহৃত এসি, ফ্রিজ থেকে নির্গত নিয়ন গ্যাসের উপস্থিতি বায়ুমানকে অস্বাস্থ্যকর করে থাকে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীর চারদিকে অবস্থিত ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণের আরেকটি প্রধান কারণ।

ঢাকা মহানগরে ধারণক্ষমতার ৬ গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের কার্বন নিঃসরণ, মহানগরের উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে ধুলার আধিক্য বায়ুমানকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে। পর্যাপ্ত গাছগাছালি এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া ও দখল হয়ে যাওয়া খাল পরিস্থিতিকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে প্রতি বছর দূষিত বায়ুর কারণে পৃথিবীতে ৭০ লাখ প্রাণহানি ঘটে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থা ইউনিসেফের উদ্যোগে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত গত নভেম্বরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু শরীরে উচ্চমাত্রার সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলছে, বড় হয়ে তাদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার শঙ্কাও প্রবল। সেখানে ঢাকাসহ দেশের পাঁচ জেলায় শতভাগ শিশুর শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, ব্যাটারি পুনর্ব্যবহারের কারখানা, ফেলে দেওয়া ইলেকট্রনিক সামগ্রী, রং, অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের তৈজসপত্র, কসমেটিকস, জালের কাঠি, খাবারের প্যাকেটে ব্যবহৃত রং, খেলনা, ধাতব গহনাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্যে ব্যবহৃত সিসা থেকে এর বিষক্রিয়া ছড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশু বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে আইসিডিডিআর,বির প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমান জানান, ঢাকা শহরে ২৪ থেকে ৪৮ মাস বয়সী ৫০০ শিশুর ওপর তাঁরা এই গবেষণা পরিচালনা করেন। শিশুর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করার পর দেখা যায়, সব শিশুর রক্তেই সিসার উপস্থিতি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সিসা শিশুর মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যেসব শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা বেশি থাকে, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।’