আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই উল্লেখ করে বাজেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছে গবেষণা সংস্থাগুলো। এ আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির তথ্য পাওয়া গেল। গেল মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে এসে ঠেকেছে। এর আগের রেকর্ড ছিল ২০১২ সালের মার্চ মাসে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি বা বাজারে পণ্য ও সেবার দর বেড়ে যাওয়ার বার্ষিক হার প্রকাশ করেছে।
কোনো নির্দিষ্ট মাসে বাজারে বিভিন্ন পণ্য এ সেবার মূল্যসূচক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কতটুকু বাড়ল, তার শতকরা হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি। বিভিন্ন পণ্য ও সেবা বাবদ মানুষের খরচের হিসাবের ভিত্তিতে প্রতিমাসের ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) তৈরি করে থাকে বিবিএস। গ্রাম, শহর ও সিটি করপোরেশনের ১৫৪টি বাজার থেকে নেওয়া ৭৪৯ ধরনের ৩৮৩ আইটেমের পণ্যমূল্যের তথ্যের ভিত্তিতে এই মূল্যসূচক নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিবিএসের আগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে এর আগে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয় গত বছরের আগস্ট মাসে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। অবশ্য পরের মাসগুলোতে সামান্য কমলেও তা ৯ শতাংশের আশপাশে ছিল। গত এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ২৪ এবং মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিবিএস বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানও প্রকাশ করেছে। গত জুন থেকে সমাপ্ত মে মাস পর্যন্ত এক বছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে। এ হার সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অনেক ওপরে। চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সমকালকে বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন কিছুটা হতাশারই। অনেক কারণে এরকম হয়ে থাকতে পারে। ডাল, চিনি, তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মজুত কিছুটা সীমিত। এর পেছনে আবার ডলার সংকট। বাজার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা দুর্বলতা আছে সন্দেহ নেই। কারণ, যে মুহূর্তে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত হলো, ঠিক তখন থেকে বাজারে দর কমল। তার মানে বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন রয়েছে। তবে ঠিক তা নিয়ন্ত্রণ নয়। বাজার পরিস্থিতি বুঝে খুব দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনীয় এরকম সিদ্ধান্ত এবং প্রয়োজনীয় যে কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির বোঝা হালকা করতে সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে।
আইএমএফের পরামর্শে এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় পদ্ধতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ২০২১-২২ বছরকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে এ হিসাব করা হতো। নতুন পদ্ধতিতে পণ্য এবং সেবার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তা মূল্যসূচকে ৭৪৯ ধরনের ৩৮৩ আইটেমের পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতদিন ৪২২টি পণ্যের বাজারদর হিসাব করা হতো। নতুন হিসাবে মদ, সিগারেট, বেভারেজ ও মাদকদ্রব্য, সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবারের ইন্টারনেটের খরচ, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে খাবারের খরচসহ আরও বেশ কয়েকটি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যোগাযোগ খাতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ই-মেইলের ব্যবহারে ইন্টারনেটের ব্যবহারও এর আওতায় আসে।

বিবিএসের প্রতিবেদন বিশ্লষেণে দেখা যায়, গেল মে মাসে খাদ্যপণ্যের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক বেশি। মাসটিতে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর খাদ্যপণ্যে ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত মার্চ থেকেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামের চেয়ে শহরে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। মে মাসে গ্রামে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশিমক ৮৫ শতাংশ, শহরে যা ৯ দশিমক ৯৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও গত মার্চ থেকেই পরিবর্তন আসে। আগের মাসগুলোতে শহরের চেয়ে গ্রামের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল।

বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি সেবার ক্ষেত্রেও ভোক্তা ব্যয় অনেক বেড়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাসা ভাড়া, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্যস্ফীতির গড় মূল্যস্ফীতি অর্থাৎ মে পর্যন্ত গত এক বছরে বেড়েছে ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে অর্থাৎ চিকিৎসা বাবদ ৮ দশমিক ৮৯ এবং যাতায়াত বা পরিবহনে ৭ দশিমক ৭১ শতাংশ।
জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআইর ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ সমকালকে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক। মূল্যস্ফীতির জন্য মূলত অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনাই দায়ী। যুদ্ধের অভিঘাতের মধ্যেই বাংলাদেশের সমপর্যায়ের দেশ কিংবা ইউেরাপ-আমেরিকাসহ অনেক দেশই অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতি গত বছরের জুনের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে গত এপ্রিলে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতিও ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে নেমে এসেছে। তিনি মনে করেন, প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু পদক্ষেপ আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ঠিক; তবে সে হারে বাড়েনি সাধারণ মানুষের আয়। বিবিএসের প্রতিবেদনের মজুরি সূচক অংশে দেখা যায়, মে মাসে মজুরি মূল্যসূচক ভোক্তা মূল্যসূচকের চেয়ে অনেক কম। মূল্যস্ফীতি যেখানে বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, সেখানে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। মজুরির এ গড় বৃদ্ধির চেয়ে শিল্প এবং নির্মাণ খাতে মজুরি আরও অনেক কম। খাত দুটিতে মজুরি বেড়েছে যথাক্রমে ৬ দশিমক ৯১ এবং ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ হারে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। দেশে জ্বালানি মূল্য সমন্বয় ও খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে। মূল্যস্ফীতি কমে আসার প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বছরের শেষ দিকে কৃষিতে ভালো ফলনের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। বাজেট পর্যালোচনায় গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ না থাকাই প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।