এবারের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে অর্থনীতির এক কঠিন সময়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি  মোকাবিলায় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রেক্ষাপটে বাজেট পেশ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হলো আইএমএফের শর্ত এবং জ্বালানি সরবরাহে বাধা উতরানো। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত যে, এসব অগ্রাধিকার মোকাবিলায় সর্বোচ্চ মনোযোগ প্রয়োজন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের সামনের দিনে ট্রিপল ট্রানজিশন– এলডিসি তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ, উচ্চ মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি গ্রহণের লক্ষ্য রয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে কি বর্তমান সময়ের এবং দীর্ঘমেয়াদি অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটেছে? এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর পাশাপাশি কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। আকার খুব বেশি না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে বাজারে অযৌক্তিক অর্থ সরবরাহকে রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু এই আকারের মধ্যেও বিপরীতমুখী কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। সরকারের পরিচালন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৫ শতাংশ এবং সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বেসরকারি খাতের প্রয়োজনীয় ঋণের চাহিদার জোগান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হবে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও বাস্তবসম্মত নয়। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বা বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার আলোকে বাস্তবসম্মত নয়। এটি বরং বেসরকারি খাতের জন্য উদ্বেগ বাড়াবে এবং কর কর্মকর্তাদের ব্যবসার ওপর অতিরিক্ত চাপ দিতে বাধ্য করবে। অন্যদিকে জিডিপির ২৮ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে অব্যাহত চ্যালেঞ্জগুলোকে আমলে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে সরবরাহে বিঘ্ন, ডলারের দাম বৃদ্ধি, স্থানীয় মুদ্রার পতন এবং ব্যবসায়ের উচ্চ খরচ শিল্প ও সেবা খাতে স্থবিরতার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে। এ রকম সময়ে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ এবং নতুন বিনিয়োগ দুটোই কঠিন হবে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের আমদানি শুল্ক ও কর আরোপ বেশ কিছু খাতে প্রভাব ফেলবে। নতুন আমদানি শুল্ক আরোপের কারণে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়বে, যার মধ্যে আনুষঙ্গিক পরিষেবা যেমন– লিফট এবং লিফট উৎপাদনকারীরা ১ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চ শুল্ক বহন করবে। ক্লিংকার আমদানি করা সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে। ক্যালসিয়াম কার্বনেট আমদানির ওপর ৪৩ শতাংশ শুল্কের কারণে চুনাপাথর উৎপাদনকারীদের উচ্চ ব্যয় বহন করতে হবে। সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর ফলে এর উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির জন্য ইস্পাত/লোহার ওপর ভ্যাট আরোপের কারণে এর দামও বাড়বে।

বাজেটে ডিজিটাল অর্থনীতি এবং কৃষি ব্যবসা খাতকে সরকার রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কৃষি ব্যবসা খাতকে উৎসাহিত করার অংশ হিসেবে সরকার কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর থেকে অগ্রিম কর প্রত্যাহার করেছে। এটি ইতিবাচকভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি, পণ্য উৎপাদন এবং কৃষি বিপণন কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করবে। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মিশ্র পদক্ষেপ রয়েছে। বাজেটে অপটিক্যাল ফাইবার উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই পদক্ষেপে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো উপকৃত হবে। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের অধীনে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ১০০ টাকার একটি তহবিল তৈরি করেছে এবং আইটি সরঞ্জামের জন্য ২০২৬ অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি বাড়িয়েছে। একই সময়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি ও সংযোজিত হ্যান্ডসেটের ওপর আরোপিত ভ্যাট বাড়িয়েছে; যা স্থানীয়ভাবে তৈরি মোবাইল ফোনের দাম বাড়াবে। আইটি খরচ বাড়বে, কারণ সফটওয়্যার আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং সফটওয়্যার উৎপাদন এবং কাস্টমাইজেশন পরিষেবাগুলোতে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
এবারের বাজেটে এমন কিছু পদক্ষেপ রয়েছে, যা সবুজ প্রবৃদ্ধিতে উত্তরণে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। পলিয়েস্টার ফাইবার ব্যবহার করা টেক্সটাইল নির্মাতারা ম্যানমেইড ফাইবারের দিকে  অগ্রসর হওয়ার পথে। তাদের উৎপাদন খরচ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। উপরন্তু, যেসব কোম্পানি সবুজ প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি মেনে চলবে তারা কর সুবিধা ভোগ করবে। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রো-ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেনের  উৎপাদনের ওপর ভ্যাট ছাড় প্রস্তাব করা হয়েছে; যা এই সম্ভাবনায় শিল্পকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট অর্থনীতির চলমান চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় কিছু সুনির্দিষ্ট কৌশল বাস্তবায়নের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। বাজেটের ভালো দিকগুলোর মধ্যে আছে নির্বাচনী বছরে তেমন জনতুষ্টিমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তার বাজেট বাড়ানো, যোগাযোগ অবকাঠামোতে ব্যয় বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপগুলো।  তবে মুদ্রাস্ফীতি এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সমস্যা মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাজেটে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অগ্রাধিকার যেমন–  বিনিয়োগ পরিবেশ এবং রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো বাজেটে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার এখনও সময় আছে এবং আমরা আশা করব যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের ওপর অগ্রাধিকার না দিয়ে এবার প্রবৃদ্ধির ভিত্তিগুলো স্থিতিশীল এবং সম্প্রসারণ করাতেই সরকার মনোযোগ দেবে।
ড. এম. মাসরুর রিয়াজ, চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ