গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এটি সরকারের ভর্তুকি ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ। টাকার মূল্যমান আরও কমলে সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যয়ও বাড়বে। ফলে মধ্যমেয়াদে সার্বিকভাবে সরকারের আর্থিক বোঝা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাজেট দলিল হিসেবে উপস্থাপিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি’ প্রকাশনায় এমন পর্যবেক্ষণ রয়েছে।

 এতে বলা হয়, কয়েক বছর ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর টাকার দ্রুত অবমূল্যায়নে বিভিন্নভাবে আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এর অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি ব্যয় এবং নির্ধারিত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে। এই অবমূল্যায়ন সরকারের রাজস্ব এবং ব্যয় উভয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

এতে আরও বলা হয়, ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৪০ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা করা হয়। সংশোধিত বাজেটে তা আরও বাড়িয়ে ৫০ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা করা হয়। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ অতিরিক্ত ৪৭৩ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, টাকার অবমূল্যায়নে ভর্তুকিতে ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলো আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ব্যয় বেড়ে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে। আগামী অর্থবছরে দেশে সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের এক বিশ্লেষণে অনুমান করা হয়েছে, টাকার মূল্যমান ১০ শতাংশ কমলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে মূল্যমান ১০ শতাংশ কমলে দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবে ঋণের মাত্রা সর্বোচ্চ টেকসই সীমার মধ্যেই থাকবে বলে আশা করছে অর্থ বিভাগ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক সমকালকে বলেন, গত আট থেকে দশ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃত্রিমভাবে টাকার মূল্যমান বাড়িয়ে রেখেছিল। আদর্শ নিয়ম হচ্ছে– বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। গত দশ বছরে রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশ ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও বাংলাদেশ করেনি। সংকট তৈরির আগেই টাকার মূল্যমান কিছুটা কমানো হলে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ত। কিন্তু হুট করে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এক ধাক্কায় টাকার মূল্যমান অনেক কমাতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে বেশি মাত্রায় টাকার অবমূল্যায়ন সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অনেক ব্যয় বেড়েছে। কারণ দেশীয় মুদ্রা আয় করে ডলারে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া আমদানির বিল মেটাতে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। যদি আরও অবমূল্য়ায়ন হয়, তাহলে ব্যয় বাড়তে থাকবে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০২২ সালের জুনে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ডলারপ্রতি ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা। গত ২৪ মে বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ১০ পয়সা। বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক চেষ্টায় বাজারে সাময়িক তারল্য সংকট তৈরি করে। এর প্রভাবে ব্যাংক উৎস থেকে ঘাটতি অর্থায়নে সরকারের সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

বিষয় : আর্থিক বোঝা টাকার মূল্যমান

মন্তব্য করুন