ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ ও তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার বিধানসহ বেশ কিছু বিষয় যুক্ত করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, তালিকা থেকে বের হওয়ার পরও পাঁচ বছর ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে অযোগ্য ঘোষণার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩’ সংসদে উত্থাপন করেন। এর আগে বিলটি সংসদে তুলতে আপত্তি জানান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।

ফখরুল ইমাম বলেন, আইএমএফের শর্ত মেনে এই সংশোধনী বিলটি আনা হয়েছে। সংসদে কোনো কিছু গোপন করা উচিত নয়। তবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কারও পরামর্শে এ সংশোধনী আনা হচ্ছে না। আধুনিক ও সময়োপযোগী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনে সংশোধন আনা হচ্ছে। পরে কণ্ঠভোটে ফখরুল ইমামের আপত্তি নাকচ হলে বিলটি উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এর পর আগামী সাত দিনের মধ্যে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পেয়েছে সরকার। এ ঋণ ছাড়ের আগে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনসহ বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। এর পর গত মার্চে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। ১৯৯১ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন প্রণয়নের পর গত ৩২

বছরে সাতবার সংশোধন হয়েছে। ব্যাংক মালিকদের চাপে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে সর্বশেষ ২০১৮ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর পরিচালক পদে থাকার সুযোগ নিয়ে আইএমএফের আপত্তি রয়েছে। নতুন আইনে টানা ৯ বছর থাকার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
বিলে একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক থাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে নতুন একটি উপধারা যুক্ত করে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকে একক পরিবারের সদস্যের অতিরিক্ত তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা নিয়ন্ত্রণাধীন অনধিক দুটি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক থাকতে পারবেন। একটি কোম্পানির পক্ষে একের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। এর মানে, একই সময়ে এক পরিবার থেকে সরাসরি তিনজন এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দু’জন থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমানে সব মিলিয়ে যেখানে চারজন থাকতে পারেন।

বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকে ন্যূনতম তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো ব্যাংকের পরিচালক এবং পরিচালকের পরিবারের সদস্যদের বা কোনোভাবে তাঁদের নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠানের সুদ বা মুনাফা মওকুফ করা যাবে না।

কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি
বিলে প্রথমবারের মতো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, নিজের বা পরিবারের সদস্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির সামর্থ্য থাকার পরও ঋণ পরিশোধ না করলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবে। তাঁদের সুবিধা কমানোর প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে ইচ্ছাকৃত ঋণগ্রহীতার তালিকা পাঠিয়ে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা, বিএসইসি ও আরজেএসসিতে কোম্পানি নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞার অনুরোধ করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

যেসব ব্যবস্থা
ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের কাছে কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুরোধ করলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বিলে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবে না। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আগে তাঁর বক্তব্য শোনাসহ কিছু বিষয় অনুসরণ করতে হবে। এর পর ওই তালিকা অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো যাবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে। কোনো ব্যাংক জ্ঞাতসারে এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বনিম্ন ৫০ লাখ ও সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে। আইনের লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রথম দিনের পর প্রতিদিনের জন্য ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে।

ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়
কোনো ব্যাংকে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান কথাটি যুক্ত করে কোনো ব্যাংকের শতকরা ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ক্রয় করতে পারবেন না। আগের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ব্যাংক কোম্পানির ‘উল্লেখযোগ্য শেয়ার ধারক’ (ব্যাংক কোম্পানির মালিকানার ৫ শতাংশের বেশি) হতে পারবেন না। ব্যাংকের পরিচালক, তাঁর পরিবার বা স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সুদ মওকুফ করতে পারবে না ব্যাংক। যেসব পরিচালক বা কর্মকর্তা দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন, তাঁরা প্রত্যেককে আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং অনূর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।


বিষয় : ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত হলেই খড়্গ

মন্তব্য করুন